সাতকাহন (১ম পর্ব) – সমরেশ মজুমদার<>Page 2

মনোরমা একটা মোড়ায় বসেছিলেন। অঞ্জলি ভেতরের দরজায় দাঁড়িয়ে। সমস্যায় পড়লেই তার হাত আঁচল তুলে ঠোঁটে চাপা দেয়। অমরনাথ তাঁর চেয়ারে। সত্যসাধন মাস্টার এসে পড়বেন এখনই।
সত্যসাধন মাস্টারকে খবর দিয়ে এসেছিলেন বুধুয়া। মনোরমা তাকে পাঠিয়েছিলেন। বিকেলের একটু আগে অমরনাথ জলপাইগুড়ি থেকে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। মেয়ের সঙ্গে তার যাবতীয় সম্পত্তি। পরনে কলেজে যাওয়ার শাড়ি। আর বাড়িতে ফিরেই সে মনোরমার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছিল। অনেক ডাকাডাকিতেও খোলেনি।
অঞ্জলি এবং মনোরমা অমরনাথকে কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলেন! বাইরের ঘরে বসে অমরনাথ ধীরে ধীরে সব কথা খুলে বলেছিলেন। এব। অনেকটাই অঞ্জলির জানা কিন্তু মনোরমা প্ৰথম শুনলো। তাঁর খেয়াল হল না যে ছেলে এতদিন কথাগুলো তাঁকে জানায়নি। বরং মনে হল দীপা খুব বোকামি করছে। তিনি বলেছিলেন, সমস্ত সম্পত্তি এমনি এমনি রেখে লোকটা চলে গেল ভাবতে কেমন লাগছে। সব দীপা পারে ৮
অমরনাথ হাত নাড়লেন আমাকে আর জিজ্ঞাসা করো না। আমি খুব ছোট হয়ে গেছি।
কেন? ছোট হবি কেন? তুই তো আর হাত পেতে কিছু নিতে যাসনি। আইন যা বলে তাই হবে। তুই দীপার গার্জেন। ওর ভালর জন্যে করেছিস। মনোরমা গজগজ করতে লাগলেন, ওইটুকুনি পুঁচকে মেয়ে মুখেব ওপর বলল লাগবে না। আর তুই চুপ করে বইলি? কেমন বুদ্ধি তোর?
অমরনাথ লক্ষ্য করেছিলেন মনোরমা বাবা না বলে গার্জেন বললেন। খট করে। লেগেছিল। শব্দটা। কিন্তু তিনি উপেক্ষা করলেন, প্রতুলবাবুকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার পর্ব আনা ওকে ভেতরে ডেকে পাঠিয়েছিল। কি বলেছিল জানি না।
তুই যেতে দিলি কেন ওকে ওই নষ্ট মেয়েছেলেটার কাছে? বাড়ির ঝি হয়ে, বাবুর সম্পত্তির দিকে হাত বাড়াচ্ছে। সাহস কি! মনোরমা মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।
অঞ্জলি এই প্ৰথম কথা বলল, আপনি তাকে দ্যাখেননি মা। আমি দেখেছি। কে বলবে বাড়ির ঝি। পোশাক, ঠমক দেখে যে-কোন পুরুষেবা মাথা ঘুরে যাবে। উনি যে ওখানে যেতেন তাতেই আমার আপত্তি ছিল।
আঃ বাজে বকো না তুমি। মনোরমা ধমক দিলেন। তারপত্র গলা নামিয়ে বললেন, তারপর কি হল?
আনার ব্যাপার নিয়ে অঞ্জলির দেওয়া খোঁচাটা ভুলতে চাইলেন অমরনাথ। হ্যাঁ, আনোব শরীরে একটা আকর্ষণ-শক্তি আছে। অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে তিনি নিজেকে খুব সংযত রেখেছেন। মায়ের প্রশ্নের জবাব দিলেন তিনি, অনেকক্ষণ বাদে ও ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। কেমন অসুস্থ দেখাচ্ছিল ওকে। আমি ছুটে গিয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করতে মেয়ে বলল, তুমি কেন এত লোভী হলে, ছিঃ আমি মাটিতে মিশে গেলাম মা। যাকে এইটুকুনি থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি। তার মুখ থেকে আমাকে ওই কথা শুনতে হল? আমি কার জন্যে লোভ করেছি? নিজের জন্যে? দু হাতে মুখ ঢাকলেন অমরনাথ। প্রতুলবাবুর রাড়ি থেকে বেরিয়ে দীপা তাঁর দিকে যে দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল তা কিছুতেই মন থেকে সরিয়ে ফেলতে পারছেন না তিনি।
বাড়ির সামনে তখন কেউ নেই। প্রশ্নটা শুনে কিছুই জবাব দিতে পারেননি অমরনাথ। হয়তো জবাব আশাও কন্বেনি দীপা। কারণ খানিক দাঁড়িয়ে সে ধীরে ধীরে হাঁটতে আরন্ত করেছিল। অমরনাথ বুঝতে পারছিলেন না। তাঁর কি করা উচিত। অসহায়ের মত তিনি মেয়েকে অনুসরণ করতে বাধ্য হলেন। আনা দীপাকে ভেতরে ডাকিয়ে নিয়ে গিয়ে ঠিক কি কথা বলেছে তার কোন আন্দাজ করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু যে সব তথ্য এতদিন মেয়ের কাছে তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন তা প্ৰকাশ পেয়ে যাওয়াতে একধরনের সংকোচবোধ তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যা নাডা খেয়ে গেল দীপার একটি বাক্যে। ক্রমশ তিনি উষ্ণ হতে আরম্ভ করলেন। তাঁর মনে এমন ভাবনা ছিল যে অল্প বয়সের সম্পদ্ধযি দীপা তার জীবনেব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটিকে অস্বীকার করছে। ওই বন্যাসে অনেকেই ন্যায়নীতি নিয়ে বাডবাড়ি করে থাকে। কিন্তু বন্যাস বাডলে, বাস্তববুদ্ধি প্রখর হলে অমরনাথ যখন ঘটনাটা প্ৰকাশ করবেন। তখন প্রতুলবাবুর সম্পত্তি গ্রহণ করতে হয়তো আপত্তি থাকবে না। অভাবের আঁচ যাব গায়ে লাগেনি সে অনেক ত্যাগ করতে পারে। কিন্তু সত্যিকারেব, অভাবীর পক্ষে সংসারে থেকে তাগোবি কথা বলা খুব নির্মম ব্যাপার।
অমরনাথ দ্রুত পা চালিয়ে মেয়ের সূঙ্গ নিলেন। কিন্তু প্রশ্ন করতে গিয়েও সামলে নিলেন তিনি। কি প্রশ্ন করবেন? কি বলল আনা, কেন দীপা তাঁর মুখের ওপর অমন ভয়ানক কথাটা বলল? মেয়েবে মুখেব দিকে আডচোখে তাকিয়েই তিনি বুঝে গেলেন প্রশ্নগুলো কিবা নিবথক। একদম পাথরের মত মুখ হয়ে গেছে মেয়েবে। চুপচাপ তাঁরা হেটে এসেছিলেন কবলা নদী পর্যন্ত। তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না এখন দীপা কোথায় যাবে। কলেজে যাওয়ার নাসিক তা নিশ্চয়ই থাকতে পারে না। তাঁর মনে হল ওকে চা-বাগানে নিয়ে যাওয়া উচিত। এই মানসিক টালমাটালের সময় অঞ্জলির উপস্থিতি ওকে সাহায্য কবনে কিন্তু কলেজ খোলা থাকলে হোস্টেল থেকে ছুটি পাওয়া যায় কিনা তা তার ধারণায় ছিল না। ঝুলন ব্ৰিজের ওপরব উঠে তিনি প্রথম কথা বললেন, এখন হোস্টেলে গেলে বড়দিকে পাওয়া যাবে?
দীপা দাঁড়িয়ে পড়েছিল, কেন?
না, মানে, আমি ভাবছি, তুই যদি কদিন বাড়ি থেকে ঘুরে আসতিস ভাল হত।
আমি চা বাগানেই যাচ্ছি। দীপা আবার হাঁটা শুক করল।
বাকি পথটা কোন কথা হয়নি। হোস্টেলে পৌঁছে গেস্ট রুমে বসেছিলেন অমরনাথ। যেন একটা বিরাট ঝড় আজ রয়ে গেল! আর যাই হোক মেয়ের মুখে নিজে বা সম্পর্কে অমন কথা শোনার পাব থেকেই ক্ৰমশ শূন্যতাবোধ ঘিরে ধবছে তাঁকে, অমরনাথ দেখলেন বড়দি বেবাঁ হচ্ছেন তাঁর কাজে। তিনি চটজলদি সামনে গিয়ে নমস্কার করলেন, নিমস্কার। আমার মেয়ে দীপাকে একটু বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই যদি আপনোক আপত্তি না থাকে।
এখন তো কলেজ খোলা। কোন জরুরী কারণ আছে?
হ্যাঁ, আনাদের এক–। নিজেকে সামলে নিলেন অমরনাথ। আত্মীয় শব্দটা ব্যবহার করলে যদি আবার দীপার কাছে বিপাকে পড়তে হয়। তিনি বললেন, একজন খুব কাছের মানুষ মারা গিয়েছেন–।
ও হো। তাহলে তো নিশ্চয়ই যাবে। ও আছে হোস্টেলে?
হ্যাঁ।
সেকি। কলেজে যায়নি?
যাচ্ছিল। পথে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
ও। ঠিক আছে। নিয়ে যান। তবে এখন তো রোজ ক্লাস হচ্ছে। বেশী দিন অ্যাবসেন্ট থাকলে ও পিছিয়ে যেতে পারে। বড়দি চলে গেলেন।
জিনিসপত্র নিয়ে দীপা যখন নেমে এল নিচে তখন অমরনাথ অবাক হয়েছিলেন। টিনের ট্রাঙ্কটাতে না হয় জামাকাপড় বইপত্তর নিচ্ছে, কিন্তু বিছানা নিয়ে যাওয়ার তো কোন কারণ নেই। তিনি একটু বিরক্তগলায় কারণটা জানতে চেয়েছিলেন।
দীপা অমরনাথের মুখের দিকে না তাকিয়ে জবাব দিয়েছিল এগুলো বাড়ি থেকেই এনেছিলাম। এখানে রেখে যাওয়ার তো কোন মানে হয় না।
মানে হয় না। ফিরে এসে শোবে কোথায়?
আমি তো ফিরে আসব না।
ফিরে আসব না মানে? প্ৰায় আকাশ থেকে পড়েছিলেন অমরনাথ।
আমি আর পড়ব না। এবার তাঁর মুখের দিকে তাকিয়েছিল দীপা।
পড়বে না? সে কি? কথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি।
হ্যাঁ। চল।
আমি বুঝতে পারছি না। তুমি কি বলছ?
তুমি এতদিন আমাকে সত্যি কথা বলনি। তুমি বলেছিলে মিস্টার রায আমার বেজাল্ট দেখে ওঁর ফান্ড থেকে পড়াশুনার খরচ দিচ্ছেন। এত টাকা ভাল অবস্থাবি মেয়েরাই পায় না বলে আমার কেমন লেগেছিল। কিন্তু তোমার কথা আমি বিশ্বাস করেছিলাম। এখন যখন জানতে পেরেছি। তুমি ওদের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নিয়ে ব্যাঙ্কে রেখে আমাকে পড়ােচ্ছ তখন আর সেই টাকায় পড়ার কোন ইচ্ছে আমার নেই।
ফাঁপরে পড়লেন অমরনাথ। এবং সেটা ঢাকতে প্ৰায় চিৎকার করেই উঠলেন, তুমি বড্ড বাড়াবাড়ি করছি। কে টাকা দিচ্ছে, কোথেকে টাকা আসছে, এসব তোমার ভাবার কোন দরকার নেই। তোমার কাজ পড়াশুনা করা, সেইটেই কর।
দীপা তাকিয়ে দেখল হোস্টেলের কাজের লোকে বা অমরনাথের কথা বলার ধরনে আকৃষ্ট হয়ে উঁকি ঝুকি মারতে আরম্ভ করেছে। সে বলল, এসব কথা এখানে দাঁড়িয়ে না বললেই ভাল হয়। তুমি কি যাবে?
ওই প্রশ্নেব পর আর কথা বাড়ায়নি অমরনাথ। দুটো রিকশা ডেকে তার একটায় মালপত্তর সমেত মেয়েকে তুলে দিয়েছিলেন। দ্বিতীয়টিতে উঠে বসে রাগ অভিমান আর অসহায়তার মিশেল নিয়ে দিশেহারা হয়ে চলেছিলেন তিস্তার ঘাটের দিকে।
অঞ্জলি ইতিমধ্যে আলো জ্বেলে দিয়েছে। ছেলেরা বড় হয়ে গেছে। তাদের কৌতূহল এখন স্বাভাবিক। দিদি বাক্স-প্যাটিরা নিয়ে কলেজ থেকে ফিরে এসেছে, কেন সেটা জানতে চেয়েছে মায়ের কাছে। দিদি ঠাকুমার ঘরের দরজা বন্ধ করে রেখেছে। তার কাছে পৌঁছানোর উপায় নেই। তাছাড়া তার গভীর্যের কারণে সব কথা জিজ্ঞাসা করা যায় না। ভেতরের বারান্দায় হ্যারিকেন জ্বালাতে জ্বালাতে অঞ্জলি বলেছিল, সব ব্যাপারে। এ ত আগ্ৰহ কেন? তোমরা তোমাদের মত থাক।
বড়টা জিজ্ঞাসা করল, দিদির শ্বশুর মরে গেছে?
হ্যাঁ। কেউ মারা গিয়েছে শুনলে এভাবে প্রশ্ন করতে নেই।
দিদি কি আর পড়বে না?
জানি না।
না পড়লে দিদি কি করবে? দিদির কি আবার বিয়ে হবে?
সঙ্গে সঙ্গে ছোটটা বলল, এস্ম। দিদি তো বিধবা। বিধবার বিয়ে হয়?
বড় জবাব দিল, হয়। ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রবর্তন করেছেন।
অঞ্জলি এবার কড়া ধমক দিল। এ ব্যাপারে। আর কোন কথা ওদের মুখ থেকে শুনতে চায় না জানিয়ে বাইরের ঘাবে চলে এল আলো নিয়ে। আরছা অন্ধকারে মা আর ছেলে বসেছিলেন। আলো টেবিলে রেখে অঞ্জলি বলল, মাস্টারমশাই এখনও এলেন না কেন?
অমরনাথ ভাঙা গলাফ বললেন, ওঁকে কেন খবর দিতে গেলে।
মনোরমা বললেন, পারলে একমাত্র উনিই পারবেন। পড়াশুনার ব্যাপারে মাস্টাবের কথাই দেখেছি ও বেদবাক্য বলে মনে করে।
অমরনাথ তাঁর আপত্তি ও জানালেন, ঘরের কেচ্ছা বাইরের লোকে জানবে।
কেচ্ছা আবার কি! এ তো ঘরে ঘরেই হয়। তাছাড়া মাস্টার সেরকম মানুষ নয় হাজার হোক মেয়েটাকে খুব স্নেহ করে  মনোরমা দৃঢ় গলায় বললেন।
এই সময় বাইরের বারান্দায় পায়ের শব্দ হল। এবং সেই সঙ্গে সত্যসাধন মাস্টারের গলা ভেসে এল, অমরনাথবাবু আছেন না কি?
অঞ্জলি চটপট এগিয়ে গিয়ে ভেজানো দরজা খুলে বলল, আসুন।
কি ব্যাপার? হঠাৎ জরুরী তলব! দীপার কিছু হইছে না কি? বলতে বলতে সত্যসাধনবাব ঘরে ঢুকলেন। অমরনাথ ওঠাব একটু চেষ্টা করে। আবার গা এলিযে দিলেন মনোরমা বললেন, বসূন মাস্টারমশাই। আপনার সঙ্গে কথা আছে।
সত্যসাধনবাবু বসলেন। তাঁর লিংক থৈব পাঞ্জাবি থেকে ঘামেব গন্ধ পেল অঞ্জলি দরজা বন্ধ করে পাশ দি যে আসার সময়! সত্যসাধনবাবু অমরনাথের দকে তাকালেন, দােপামায়ের কিছু হইছে না কি? সে আছে কেমন?
অমরনাথ জবাব দিলেন। না। মনোরমা বললেন, দীপা এখানে চলে এসেছে।
তার কলেজ বন্ধু? সত্যসাধন মাস্টার ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলেন না।
মনোরমা মাথা না ৬লেন, না। আপনাকে সব কথা খুলে বলি। ব্যাপারটা আমাদের পরিবারের গোপন বিষয়। কিন্তু আপনাকে আমি বিশ্বাস করছি কারণ আপনি দীপাকে ভালবাসেন। আপনি জানেন ওর বিয়ে এবং বিধবা হবার ঘটনা। সেসব মন থেকে সরিয়ে ফেলেছিল। আপনি তখন ওকে সাহায্য করেছিলেন। জলপাইগুড়ির কলেজে যখন পণ্ডিতে যাওয়ার কথা হল তখন। ওর শ্বশুরমশাই নিজে অমরকে ডেকে অনুনয় করলেন যেন দীপার পড়ার খরচ তাঁকে দিতে দেওয়া হয়। তিনি প্ৰায়শ্চিত্ত করতে চান! তা সরাসরি না দিয়ে টাকাটা তিনি ব্যাঙ্কে অমর অব দীপার নামে রেখেছিলেন। বাঙ্ক থেকে প্ৰতি মাসে হোস্টেলে পাঠিয়ে দিত। অমর একথা দীপাকে বলেনি। মেয়ের যা জেদ তাতে বললেও শুনত না। এই চলছিল। ওর শ্বশুর খুবই অসুস্থ ছিলেন। আজ সকালে মাবা গিয়েছেন তা তাঁর উত্তরাধিকারী বলতে দীপা। অমর দীপাকে নিয়ে গিয়েছিল সেই বাড়িতে। সেখানে গিয়ে মেয়ের মাথা বিগড়ে গিয়েছে। অমরকে অপমান করেছে। আর সব জিনিসপত্র নিয়ে হোস্টেল ছেড়ে চলে এসেছে পড়াশুনা করবে না বলে।
সত্যসাধন মাস্টার চুপচাপ শুনছিলেন। এবার নিচু গলায় জানতে চাইলেন, কেন?
এবার অমরনাথ আচমকা গলা তুলে বললেন, তার মান গিয়েছে। প্রতুলবাবুর টাকায় তিনি পড়বেন না। আমাকে লোভী বললেন। লোভ? আরে কার জন্যে আমি করছি? নিজের জন্যে না ছেলে দুটোর জন্যে? তোরই তো ভাল চাই।
অঞ্জলি চাপা গলায় ধমকে উঠ, আঃ। কি হচ্ছে কি? এসব কি বলছ চিৎকার করে? মেয়েটা শুনতে পেলে ভাল হবে?
পাক। এ বুড়িতে ওর ভয়ে আমাকে চুপ করে থাকতে হবে? হোস্টেলে থেকে মেয়ে বিদ্যোধরী হবে, আমার পয়সায় পড়লে বাকিদের বঞ্চিত করা হবে এ চিন্তা তার মাথায় কখনও এসেছে? এত জেদ কিসের, অ্যাঁ? ক্ষিপ্ত দেখাচ্ছিল অমরনাথকে।
মনোরমা শান্ত গলায় বললেন, আমর, তুই যদি এমন করবি তাহলে আর কথা বলে লাভ কি! মাস্টারমশাইকে কষ্ট দিয়ে ডেকে আনলাম।
অমরনাথ হাত নাড়লেন অসহায়ভাবে কিন্তু মুখে কোন কোন কথা বললেন না।
সত্যসাধন মাস্টার চুপচাপ শুনছিলেন এতক্ষণ। এবার বললেন, আমি একটা কথা সাপোর্ট করি না। অমরনাথবাবু তার গুরুজন। উনারে সে যদি অপমান কইরা থাকে তাহলে এতদিনের সব শিক্ষা বৃথা। পিতা ও মাতা দেবতার মত।
হয়তো হত। যদি আমি নিজের বাবা হতাম। আমি কাক, কোকিলের ডিমকে নিজের ডিম ভেবে এতকাল তা দিয়েছি। অমরনাথ আক্ষেপ করলেন।
হঠাৎ অঞ্জলি চাপা গলায় ধিক্কার দিয়ে উঠল, ছিঃ।
শব্দটা এমন জোরালো ছিল যে ঘরের সবাই একই সঙ্গে তার মুখের দিকে তাকাল। অঞ্জলি বলল, তুমি ওই কথাটা উচ্চারণ করতে পারলে?
অমরনাথ স্ত্রীর চোখে চোখ রাখতেই কুঁকড়ে গেলেন। দু হাতে কপাল চেপে ধরলেন তিনি। সত্যসাধন মাস্টার উঠে এলেন তাঁর পাশে, ঠিক আছে, আপনার মনের অবস্থায় মাথা ঠাণ্ডা রাখা সত্যই মুশকিল। কিন্তু সে অনেক ছোট। আমাদের তো একটু উদার হতেই হয়। আপনি নিজেকে সংযত করেন অমরনাথবাবু।
অমরনাথ কোন জবাব দিলেন না। কিন্তু তাঁকে খুবই অনুতপ্ত দেখাচ্ছিল।
সত্যসাধন মাস্টার ঘুরে দাঁড়ালেন, সে কোথায়?
মনোরমা গালে হাত দিয়ে বসেছিলেন, আমার ঘরে বসে আছে দরজা বন্ধ করে।
সত্যসাধন মাস্টার জিজ্ঞাসা করলেন, তার লগে তো কথা কওয়া দরকার।
মনোরমা অঞ্জলির দিকে মুখ ফেরালেন, যাও, বলে মাস্টারমশাই দেখা করতে এসেছেন। অঞ্জলি পা বাড়াচ্ছিল, মনোরম আবার ডাকলেন, বউমা। আজ তোমরা মাথা গরম করছি। কিন্তু যেদিন ওই একদিনের বাচ্চাকে নিয়ে এসে তুমি আমার অনুমতি চেয়েছিলে সেদিন আমি কি বলেছিলাম মনে আছে?
অঞ্জলি জবাব দিল না।
মনোরমা অপেক্ষা করলেন না, আমি আপত্তি করিনি শুধু বলেছিলাম। আমৃত্যু মাথায় এই চিন্তা এনে না যে সে তোমাদের রক্তে জন্মায়নি। আজও বলি, চিন্তাটা মাথায় এলে তোমরা যেমন কষ্ট পারে সেও তা থেকে বাদ যাবে না। এতদিনের পরিশ্রম তো মিথ্যে ছিল না। তাহলে আজ কেন ওসব কথা তুলছ তোমরা।
অঞ্জলি একবার শাশুড়ি আর একবার স্বামীর দিকে তাকাল। তার মনে হল এই কথাগুলো মনোরমা অমরনাথকে শোনানোর জন্যই বলছেন। মনটা খানিক হাল্কা হল তার। সে কোন কথা না বলে ভেতরে চলে এল।
মনোরমার বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অঞ্জলি ডাকল, দীপা।
প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে জবাব এল, আমাকে এখন বিরক্ত করো না।
বলার ভঙ্গী এবং কথাগুলো শুনে অত্যন্ত বিরক্ত হল অঞ্জলি। সে উষ্ণ গলায় বলল, তোমাকে বিরক্ত করার বিন্দুমাত্র বাসনা আমার নেই। সত্যসাধন মাস্টার এসেছেন, তিনি তোমাকে ডাকছেন বলেই আমাকে আসতে হল। কি বলব। দয়া করে বলে দাও।
এতেই কাজ হল। ধীরে ধীরে দরজা খুলল। কিন্তু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সমস্ত উষ্ণতা উধাও হয়ে গেল অঞ্জলির। দীর্ঘ সময় ধরে কাঁদলে কোন মানুষের মুখ এমন ফুলে যায়। কিন্তু নিজেকে সংযত করল সে। কোন কথা না বলে মেয়ের আগে আগে বাইরের ঘরের দরজা পর্যন্ত এসে ইঙ্গিতে মনোরমাকে জানাল দীপা আসছে।
সত্যসাধন মাস্টার দেখলেন অত্যন্ত কুষ্ঠিত ভঙ্গীতে দীপা এসে দরজায় অঞ্জলির পাশে দাঁড়াল। তিনি ডাকলেন, এখানে আসে। এই খাটের উপরে বসো।
দীপা চোখ তুলে মাস্টারমশাইকে দেখল। তারপর হঠাৎই সব কুষ্ঠা ঝেডে ফেলে। ঘরের এ প্রান্তে খাটের। কাছে এসে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। সে ভুলেও একবারও অমরনাথের দিকে তাকাল না। সত্যসাধন তাঁর ছাত্রীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন। এবার বললেন,  তোমাকে একটা প্রশ্ন কবি। কোন বস্তু গ্রহণ করবার সময় লজা, মান সম্মান, দাবিদ্রা, অর্থকে প্ৰতিবন্ধক হিসাবে কল্পনা করে নিবোঁধবা?
দীপা জবাব দিল না। তার ঠোঁট মৃদু নড়ল মাত্ৰ।
সত্যসাধন মাস্টার মাথা নাড়লেন, জবাব দাও! তোমারে এতকাল যা শিক্ষা দিলাম তাক কতটা গ্ৰহণ করছি দেখি।
ভালবাসা। দীপা জবাব দিল নীচু গলায়।
সম্ভবত এই উত্তরটা আশা করেননি। সত্যসাধন। তিনি সোজা হয়ে বসলেন। তাবপািব হেসে বললেন, ঠিক। কাবেক্ট। আর?
দীপা মাথা নাড়ল। সে জানে না।
শিক্ষা। সত্যসাধন নিজেই উত্তব্যটা দিলেন, শিক্ষিত হইতে চাইলে কোন লজ্জা মান সম্মান অভিমানকে প্রশ্রয় দেওয়া বোকামি।
আত্মসম্মান?
হ্যাঁ। আত্মসম্মানও। কারণ এটি এমন এক বস্তু যে চিরকাল একই চেহারায থাকে না। তোমার আত্মা আজ যে-সকল জিনিসের দ্বারা অপমানিত বোধ করতেছে তা আগামীকাল সেইভাবে নাও ভাবতে পারে। বয়স অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষা মানুষকে উদার করে। উদারতা অনেক সময় মান অপমান বোধকে চালিত করে। আজ যে ব্যাপারে তোমার আত্মসম্মানে, আঘাত লাগতেছে। কাল সেটা গুরুত্বহীন হইতে পারে। কিন্তু শিক্ষা কখনই বৃথা যায় না। বিদ্যার জন্য মানুষ, প্রকৃত মানুষ চিরকাল নত মস্তকে থাকে। বিদ্যা বিনয় দান করে। আবার বিনীত না হইলে বিদ্যার্জন সম্ভব নয়। আশা করি আমার কথা তোমার বোধগম্য হইতেছে?
আমি ওদের বাড়ির টাকায় পড়াশুনা করব না।
কারণ?
ওদের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক স্বীকার করি না।
তাঁরা তো কেউ জীবিত নাই।
কিন্তু আমার কাছে সমস্ত ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।
স্নেহ অতি বিষমবস্তু। অমরনাথবাবু তোমার মানসিকতা বুঝিয়াই তোমারে তখন কিছু জানান নাই। হ্যাঁ, সেই কাজটা ঠিক হয় নাই।
কিন্তু কেউ করুণা করে আমাকে টাকা দিয়েছে পড়াশুনা করতে—।
করুণা? এটা কি বললা? তুমি জানতা কোন এক বড়লোক তাঁর ট্রাস্টি হইতে তোমার পড়াশুনার খরচ দিতেছে। সেইটারে করুণা ভাব নাই কেন?
ভেবেছিলাম এটা অনেকেই পেয়ে থাকে?
খোঁজ নিছিলা তোমাদের কলেজের আর কেউ ওই টাকা পায় কিনা?
না।
কেন? এ ব্যাপারে আগ্রহ হয় নাই কেন?
টাকা পয়সার ব্যাপারে আমার কখনও আগ্রহ হয়নি।
চমৎকার। আজ নতুন কইর‍্যা আগ্রহের কি দরকার। শোন মা, টাকাব্য গায়ে কারো নাম লেখা থাকে না পাপীর টাকা। যদি পুণ্যের জন্যে ব্যয় হয় তাইলে সেটায় আর পাপের গন্ধ থাকে না।
দীপা জবাব দিল না। কিন্তু তার ভঙ্গী দেখে বোঝা যাচ্ছিল এসব কথায্য সিদ্ধান্ত বদল করতে রাজী নয়। সত্যসাধন মাস্টারও ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। একটু হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, ধরে তোমার কথাই ঠিক। তাইলে এখন তুমি কি করবা?
মাথা নাড়ল দীপা, জানি না।
চমৎকার। এতদিন এত বছর যত পরিশ্রম করছি সব জলাঞ্জলি দিয়া যদি ঘরে বইসা থাক তাইলে তো তুমি আমার মুখ সত্যি উজ্জ্বল করবা।
দীপা কথাগুলো শুনে করুণ চোখে তাকাল। একটু ভেবে বলল, আমি না হয় প্রাইভেটে পরীক্ষা দেব।
না হয়! যেন কোন কিছু করব নাই। বইল্যাই পরীক্ষা দেব? ছি ছি। এই চা-বাগানে কার কাছে তুমি পড়বা? প্রাইভেটে পরীক্ষা দেওয়া যদি সোজা হইত তাইলে কেউ কলেজে ভর্তি হইত না।
এবং এই প্ৰথম কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল দীপা। সত্যসাধন মাস্টার এবার অপেক্ষা করলেন। যতক্ষণ দীপা শান্ত না হয় ততক্ষণ তিনি চুপ করে রইলেন। নিশ্বাস খানিক স্বাভাবিক হয়ে এলে দীপা বলল, ওদের টাকায় পড়াশুনা করার কথা ভাবলে মনে হয় গায়ে নোংরা। লাগল। বিয়ের দু দিনের কথা তখন কিছুতেই ভুলতে পারি না। তাছাড়া বাবা কেন আমার কাছে সব লুকিয়ে রাখল। একদিন না একদিন আমি নিশ্চয়ই জানতে পারতাম। লুকিয়ে রেখে কি লাভ হল!
সত্যসাধন মাস্টার বললেন, আমি তো প্ৰথমেই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করছি। অমরনাথবাবু কাজটা ঠিক করেন নাই। কিন্তু তুমিও খুব অন্যায় করতেছ দীপা।
অন্যায়? দীপা চোখ তুলল।
নিশ্চয়। বিদ্যার গায়ে কাদা লাগে না। কেউ যদি কোনদিন কোন খারাপ কাজ করে তাইলে নিজেকে রেক্টিফাই করা চলবে না, এ কি ধরনের কথা? তুমি তো অনেক সময় ভুল কইর‍্যা পরে আমার কাছে ক্ষমা চাইছ, আমি যদি ক্ষমা না করতাম? আমি যদি আর তোমারে পড়াইতে না আসতাম? তোমার শ্বশুর প্রায়শ্চিত্ত করবার চেষ্টায় ছিলেন। সেইটা তো মিথ্যা নয়। সেই চেষ্টারে তুমি কেন অসম্মান করব। যাও, ঘরে যাও, এখনই তোমার মতামত দিতে হইব না। আমার কথাগুলান ভাবো। কাল সক্কালে আসবা। আমার কাছে। RN3
দীপা মাস্টারমশাই-এর দিকে একবার তাকিয়ে ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে ভেতরে চলে গেল। মনোরমা অঞ্জলিকে ইশারা করতেই সে মেয়ের সঙ্গ নিল। সত্যসাধন মাস্টার উঠে দাঁড়ালেন, এখন চলি অমরনাথবাবু, চলি মা।
মনোরমা জিজ্ঞাসা করলেন, কি বুঝলেন?
কাল সকাল পর্যন্ত ওরে কিছু না বলাই ভাল। কিন্তু একটা কথা অমরনাথৰ্বাবু, ইউ শুড় বি প্রাউড অফ ইয়োর ডাঁটার। দীপার মত ছাত্রী পাইছি বইল্যায় আমিও আজ গর্বিত। নমস্কার। ব্যাগ থেকে টর্চ বেবাঁ করে বাইরের দরজা খুলে বারান্দায় পা রাখলেন সত্যসাধন মাস্টার।
মাঠের ভিতর দিয়ে আসাম রোডে পৌঁছানো পর্যন্ত তিনি অন্যমনস্ক ছিলেন। ওইটুকুনি একটি মেয়ে এতখানি আত্মসম্মানবোধ কি করে অর্জন করল? এতক্ষণ যত উপদেশই তিনি দিয়ে থাকুন। সেগুলো যে খুব জোবালো নয় তা তাঁর চেয়ে আর কে বেশী জানে। এখন মনে হচ্ছে দীপারও সেটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। কিন্তু তিনি কি করতে পারতেন? সঙ্গত কারণেই জেদ দেখিয়ে সরে দাঁড়ালে মেয়েটার সারা জীবন মুখ থুবড়ে থাকবে। নিজের পায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবাব চেষ্টা ও ক্ষমতা আছে এমন ছাত্রছাত্রী। তিনি কখনই পাননি। wীপা ব্যতিক্রম। সেই দাঁড়াবাব মুহূর্তে যদি অভিমান বা আত্মসম্মানবোধ এসে আঘাত করে তাহলে তিনি সমর্থন করতে পারেন না। ভাল কাজের জন্যে কখনও কখনও মন্দোব সঙ্গে সমঝোতা করতে হয়। তিনি দােপাকে তাই করার উপদেশ দিয়েছেন।
আসাম রোড নির্জন। দুপাশে বড় বড় দেওদার গাছে ঝিঁঝি ডাকছে। বেশ কিছুটা দূরে  চা-বাগানের বাবুদের কোব্যাটার্সে জ্বলা হ্যারিকেনেবা টিমটিমে আলো অন্ধকারকে আরও ঘন করে তুলেছে। টৰ্চের আলো মিইয়ে এসেছে। এ মাসে স্কুলে মাইনে হয়নি। এমনিতে হাতে যা পান তাতে দুবেলা ভাত-ডালেব বেশী কিছু জোটে না। ব্যাটাবি কেনার টাকা এখনই যোগাড় করার কথা চিন্তা করতে পারেন না তিনি। তাই পথ চলতে মাঝে মাঝে সুইচ টিপে টার্চ নিবিয়ে রাখছিলেন। একবার জেলে যতটা হাঁটা যায়।
আঙবাভাসার পুলেব কাছে এসে তিনি মানুষটাকে দেখতে পেলেন! টৰ্চের আলো পায়ের কাছে ফেলে জিজ্ঞাসা করলেন,  কে?
আমাকে তো চেনার কোন কারণ নেই। গলার স্বরে বোঝা গেল বক্তাব বন্যস হয়েছে কিন্তু ব্যক্তিত্ব অটুট। কাছাকাছি হতেই সত্যসাধন আবিষ্কাব করলেন মানুষটিব পবনে গেরুয়া লুঙ্গি এবং ফতুয়া, কাঁধে ব্যাগ আর মুখে সাদা দাড়ি। তাঁকে এটা দেখাব জন্যে টর্চ জ্বালাতে হয়েছিল।
আপনাকে এব। আগে তো দেখি নাই।
হ্যাঁ। আমি এইমাত্র পৌঁছেচি। চা-বাগানটা কি ওই দিকে?
আজ্ঞে খাঁ। কার কাছে। যাইবেন? মানে, এই অন্ধকারে তো ঠাওর করা মুশকিল। আপনি আগে আসেন নাই, আপনার তো অসুবিধা আরও বেশী।
অমরনাথ মুখোপাধ্যায়। সে তো এই চা-বাগানেই চাকরি করে?
হ্যাঁ। আমি তাঁর কোয়ার্টার্সে ছিলাম এতক্ষণ। ঠিক আছে, চলেন, আমি আপনারে নিয়া যাই। সত্যসাধন মানুষটিকে নিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। বেশ কৌতূহল হচ্ছিল তাঁর। হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি সন্ন্যাসী বইল্যা মনে হয়।
হ্যাঁ। যোশীমঠের কাছে আমার আশ্রম। নিজের প্রয়োজনেই অনেক খোঁজাখুঁজি করে এখানে এসেছি। আপনি ওদের ভাল করে চেনেন?
ঘনিষ্ঠভাবে চিনি। অমরনাথবাবুর কন্যার গৃহশিক্ষক ছিলাম। আমি।
ছিলেন মানে?
ছাত্রী বড় হইয়া কলেজে ভর্তি হইছে।
ও। আর কে কে আছে ওদের বাড়িতে?
অমরনাথবাবুর স্ত্রী, দুই পুত্র মা।
সন্ন্যাসী নিঃশ্বাস ফেললেন, অমরনাথের জননী জীবিত?
আজ্ঞে হ্যাঁ। তাঁকে তো তেমন বয়স্ক মনে হয় না। কিছু যদি মনে না করেন, আপনার লগে ওঁদের কি সম্পর্ক?
এখন কোন সম্পর্ক নেই। বুঝতেই পারছেন, আমি কিছুই জানি না।
আসাম রোড ছাড়িয়ে মাঠের ভেতর দিয়ে ততক্ষণে তাঁরা অমরনাথের কোয়ার্টার্সের সামনে পৌঁছে গিয়েছেন। সত্যসাধন মাস্টার দরজার কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে অঞ্জলির গলা পাওয়া গেল,  কে?
সত্যসাধন বললেন, আমি মাস্টারমশায়। একটু দরজাটা খোলেন।
অঞ্জলি হ্যারিকেন হাতে দরজা খুলতেই সত্যসাধন মাস্টার বললেন, ইনি আপনাদের লগে দেখা কইরাতে আইছেন। আমি কেয়াটার্স চিনইয়া দিলাম।
অঞ্জলি হ্যারিকেন ওপরে তুলতেই গেরুয়া বসনধারী সন্ন্যাসীকে দেখতে পেল। সে খুব আশ্চর্য হয়ে বলল, বলুন।
সন্ন্যাসী বললেন, তোমার পরিচয় জানতে পারি?
সত্যসাধন জবাব দিলেন, উনি অমরনাথবাবুর পরবার।
ও। সে কোথায়?
অঞ্জলি বলল, উনি খুব ক্লান্ত। শুয়ে আছেন।
অ। অমরনাথের জননীকে ডেকে দেওয়া যেতে পারে?
আপনি ভেতরে এসে বসূন।
সন্ন্যাসী একটু ইতস্তত করে বাইরের ঘরে ঢুকে নিজেই মোড়া টেনে নিলেন। অঞ্জলি দশাসই মানুষটির দিকে সভয়ে তাকান। খুব সাধারণ চেহারার মানুষ নন। ইনি এমন ধাবণা জন্মাল। সত্যসাধন মাস্টার বললেন, আমি তাইলে চলি। নমস্কার।
বাইরের দরজাটা বন্ধ না করে অঞ্জলি ভেতরে এল। শোওয়ার ঘরে অমরনাথ তখন খাটে লম্বা হয়ে চোখে হাত চাপা দিয়ে পড়ে আছেন। অঞ্জলি তাঁর কাছে এসে চাপা গলায় বলল, শুনছ, একজন সন্ন্যাসী এসে প্ৰথমে তোমার, তারপর মায়ের খোঁজ করছেন। বাইরের ঘরে বসে আছেন।
হাত সরালেন চোখ থেকে অমরনাথ, সন্ন্যাসী? ধুর্ত। চলে যেতে বল।
কি করে বলব?
কি করে বলবে মানে? রাত দুপুরে সন্ন্যাসীর সঙ্গে কথা বলার মেজাজ এখন আমার নেই। বলে দাও ধৰ্মটৰ্মে আমার কোন আস্থা নেই। মুখ ব্যাজার করলেন অমরনাথ, শুধু পয়সা বাগাবার ধান্দা।
উনি মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।
বেশ তো। মাকে গিয়ে বলো।
মেয়েটার এই অবস্থা আর বাড়িতে সন্ন্যাসী এল, কোন যোগাযোগ আছে কিনা কে জানে? বিড় বিড় করতে করতে অঞ্জলি মনোরমার ঘরের দিকে পা বাড়াল। দরজা ঠেলে দেখল। দীপা খাটের ওপর চুপচাপ বসে আছে। মনোরমা তাঁর ঠাকুরের সামনে বাবু হয়ে বসে জপ করছেন। অঞ্জলি মৃদু গলায় ডাকল, মা।
মনোরমা প্ৰথমবারে সাড়া দিলেন না। দ্বিতীয়বারে নিঃশব্দে তাকালেন।
অঞ্জলি বলল, একজন সন্ন্যাসী এসেছেন। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন। মনোরমার মুখে বিরক্তি ফুটে উঠল। জপেব সময় তিনি কথা বলতে চান না। আজ বিকেল থেকে বাড়িতে যে ঝড় বইছে তাতে ঠাকুরেব সামনে নিশ্চিন্তে বসার সুযোগ পাননি। তিনি মুখ ঘুরিয়ে আবার জপে মন দিলেন।
অঞ্জলি বুঝল শাশুড়ি উঠবেন না এখন। সে বলল, ওকে বসিয়ে রাখছি।
মনোরমা ঈষৎ ঘুরে দীপাকে ইঙ্গিত করলেন। ইঙ্গিতটা দীপা বুঝল। সে খানিকটা অনিচ্ছা নিয়ে খাট থেকে নেমে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। ব্যাপারটা অঞ্জলিকে আহত করল। দীপাকে না পাঠিয়ে মনোরমা তাকেই ইসাবাটা করতে পারতেন। দীপা ততক্ষণে ভেতরের ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছে। কৌতূহল নিয়ে অঞ্জলি অভিমান সত্ত্বেও মেয়েকে অনুসরণ করল।
বাইরের ঘরে পৌঁছে দীপা দেখল। সন্ন্যাস তার দিকে তাকিয়ে আছেন। লোকটিব চাহনি অত্যন্ত সতেজ। দীপা বলল, ঠাকুমা এখন ব্যস্ত। কি বলবেন আমাকেই বলতে পারেন।
সন্ন্যাসী হাসলেন, সব পাত্রে কি সব জিনিস রাখা যায়? তোমার ঠাকুমা কখন ব্যস্ততামুক্ত হবেন?
দীপা জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার বলুন তো? আপনি কি ঠাকুমাকে চেনেন?
এ প্রশ্নও অবাস্তব! চিনতে পাবা খুব কঠিন কর্ম! তোমার নাম?
দীপাবলী?
তুমি, তোমার বিবাহ হয়েছিল?
একথা সবাই জানে।
কিন্তু তুমি খুব তেজী মেয়ে। ভাল, খুব ভাল। দ্যাখো, আমি তোমাদের এখানে ভবিষ্যদ্বাণী করতে আসিনি। আমি এসেছি আমার প্ৰয়োজনে? তোমার বাবা কি একবার এখানে আসতে পারবেন না?
এই সময় পেছনে চটির আওয়াজ হল। দীপা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল অমরনাথ দববজায় এসে বলছেন, কি ব্যপাব বলুন! রাত দুপুরে কারো কাছে আসা ঠিক নয়।
সন্ন্যাসী হাসলেন,  তোমার নাম অমরনাথ? তিনি একবার তাকিয়েই মুখ সরিয়ে নিলেন, বসো...তোমাদের সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

অমরনাথ হতভম্ব। সন্ন্যাসীর বয়স অনুমান করা সম্ভব নয়। তবে তাঁর দীর্ঘদেহের গৌরবর্ণ ত্বক যেরকম কুঁচকে গিয়েছে তাতে আশির কাছাকাছি হওয়াই সঙ্গত। মাথার জটা প্ৰায় সাদা, দাড়িতে লাল ছাপ লেগেছে সাদার গায়ে। সন্ন্যাসী জিজ্ঞাসা করলেন, কত বছর বয়সে এই চাকরিতে যোগ দিয়েছ তুমি?
অমরনাথ জবাব না দিয়ে পারলেন না, অল্প বয়সেই। এখন বলুন কি করতে পারি আপনার জন্যে। রাত অনেক হয়েছে।
তোমার জানতে নিশ্চয়ই কৌতূহল হচ্ছে। আমি কি বলতে এসেছি?
স্বাভাবিক।
আমি যা বলব। তার আগে আমার কয়েকটা তথ্য জানা দরকার। তুমি কি তোমার মাতুলালয়ে বড় হয়েছ? সন্ন্যাসী অমরনাথের মুখের দিকে তাকালেন।
হ্যাঁ। সেখানে থেকেই আমি স্কুলে পড়েছি।
তোমার পিতা–?
তিনি আমার জন্মের আগেই দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন।
কী রকম দুর্ঘটনা?
নৌকোড়ুবি।
তোমার পিত্ৰালয়ের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই?
না। কিন্তু আপনি এইসব তথ্য জানতে চাইছেন কেন?
প্রয়োজন আছে। সন্ন্যাসী হাসলেন, এটি কে?
আমার মেয়ে। অমরনাথ বুঝতে পারছিলেন যে তিনি সন্ন্যাসীর ব্যক্তিত্বের কাছে পবাস্ত হচ্ছেন। মানুষটিব দৃষ্টিতে এমন সম্মোহনী শক্তি রয়েছে যে তিনি ওঁর আদেশ পালন করতে বাধ্য হচ্ছেন। অমরনাথ ঘাড় ঘুরিয়ে অঞ্জলি এবং দীপাকে দেখলেন।
তোমার সংসারে এখন কজন মানুষ?
ছয় জন। আমার দুটি পুত্রসন্তান, এরা, আর আমার মা।
তোমরা কি সুখে দিনযাপন করছ?
অমরনাথ উত্তর দিলেন না। আজ দুপুরের পর থেকে ঈশ্বর তাঁর জীবন থেকে সমস্ত সুখ কেড়ে নিয়েছেন। দিনযাপন করতে হয় বলেই করা।
সন্ন্যাসী বললেন, তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।
গৃহী মানুষের জীবন কি সুখে বাঁধা থাকে?
থাকে না। তবু গৃহী পার্থিব সুখের চেষ্টা করে। তুমি করেছ নিশ্চয়ই!
করেছিলাম।
পাওনি? ব্যর্থ হয়েছ?
হঠাৎ দীপা জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি চান?
সন্ন্যাসী হাসলেন, উত্তরটা তোমার ঠাকুমা থাকলে দিতে ভাল লাগত।
তিনি এখন পুজো করছেন?
পুজো? তিনি কি দীক্ষা নিয়েছেন?
হ্যাঁ। দীপা উত্তরটা দেওয়ামাত্র অঞ্জলি ফিসফিস করে বলল, দ্যাখ, ঠাকুমার বোধ হয় পুজো হয়ে গিয়েছে। হলে ওঁকে এখানে ডেকে আন।
দীপা একটু জেদ দেখিয়ে বলল, দাঁড়াও, আগে শুনি ওঁর কথা।
সন্ন্যাসী দীপার দিকে তাকালেন, তুমি ছাত্রী?
হ্যাঁ। আমি কলেজে পড়ি?
হুঁ। অনেক পড়াশুনা হবে তোমার।
অঞ্জলি এতক্ষণ উশখুশ করছিল। এবার সুযোগ পেয়ে বলে ফেলল, দেখুন তো, ইনি আবার জেদ ধরেছেন জলপাইগুড়ির কলেজে পড়তে যাবেন না।
জেদ? না পড়ার জন্যে জেদ! কেন? নিজের স্বভাবের উল্টো আচরণ করছি কেন?
আমার কি স্বভাব তা আপনি জানেন? দীপা জিজ্ঞাসা করল।
তোমাদের বংশে কি কোন মেয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে?
প্রশ্নটা উত্তর দিলেন অমরনাথ, না। ও প্রথম। অবশ্য—!
অবশ্য কি?
দীপা আমাদের মেয়ের চেয়ে আপন। জন্মমাত্র ওকে আমরা সস্তানের মত লালন করেছি। আমার শ্যালিকা ওকে জন্ম দিয়েই মারা গিয়েছিল। সেই দিন থেকে যদিও বক্তেব কোন সম্পর্ক নেই কিছু আমরা মনে করি হৃদয়ের সম্পর্ক রক্তেব চেয়ে মূল্যৱান।
সন্ন্যাসী দীপার মুখের দিকে আবার তাকালেন, পড়াশুনা তোমাকে করতে হবেই মা! ত থেকে তোমার নিষ্কৃতি নেই। কিন্তু একটা কথা, অন্তত তিরিশ বছর না হলে বিবাহ করো না। বাঙালি মেয়েদের পক্ষে বয়সটা যদিও খুব বেশী। তবু তিরিশ পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত।
অঞ্জলি কৌতূহল দমন করতে পারল না, কেন?
শুনতে খারাপ লাগবে কিন্তু এ মেয়ের কপালে বৈধব্য লেখা আছে যদি অল্প বযসে বিবাহ হয়। এ ছাড়া মেয়েটি নিজের ভাগ্য নিজে গডে নেবে। অঞ্জলি জিজ্ঞাসা করল, আপনি হাত দেখতে পারেন?
সন্ন্যাসী সশব্দে হেসে উঠলেন, না মা। ওসব বিদ্যে আমার জানা নেই। তবে গুরুব তাশীবাদে কখনও কখনও কারো মুখেব দিকে তাকালে কেউ যেন কানে কানে আমাকে তার সম্পর্কে কিছু বলে যায়।
দীপা হেসে ফেলল, এই বাড়িতে আমার আগে বুঝি আপনি এখানকার কারো সঙ্গে আমাদের বিষযে, আলোচনা করেছেন?
সন্ন্যাসী অবাক হলেন, মানে? দীপা বললে, আপনি যেসব কথা বলছেন তা এখানকার সবাই জানেন।
সন্ন্যাসীর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল, কারো সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তাছাড়া তোমার ভবিষ্যতে কি ঘটবে তা সবাই জানবে কি করে?
আপনি যা ভবিষ্যতে হবে বলছেন তা অতীতে ঘটে গিয়েছে।
সন্ন্যাসী অবাক হয়ে গেলেন। অমরনাথ চুপচাপ শুনছিলেন। দীপাকে তাঁর বেশ বাচাল বলে মনে হচ্ছিল। অন্যথৰ্ক কথা বাড়াচ্ছে সে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি বলছিলেন আমার সঙ্গে আপনার কিছু কথা আছে। সেটা যদি শেষ করেন তাহলে ভাল হয়। রাত বাড়ছে। আমি খুব ক্লান্ত।
সন্ন্যাসী বললেন, এ-সময়ে এসেছি বলে আমি দুঃখিত। বেশ, আমার কথা শেষ করি।
এই সময় অঞ্জলি মুখ ঘুরিয়ে দেখল মনোরমা আসছেন। সে বলল, মা এসে গিয়েছেন। আসুন মা! সন্ন্যাসী মুখ খুলতে গিয়েও থেমে গেলেন। তাঁর চোখ এখন অঞ্জলির পাশে, দরজার দিকে। মনোরমা ধীরে ধীরে সেখানে এসে দাঁড়ালেন।
মনোরমা সন্ন্যাসীকে দেখলেন। এত রাত্রে একজন সন্ন্যাসী কখনও কারো বাড়িতে আসে বলে তিনি শোনেননি। অমরনাথ বললেন, ইনি আমার মা!
হ্যাঁ। ওঁর চেহারার সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে। সন্ন্যাসী মৃদুস্বরে বলতেই মনোরমা চমকে উঠলেন। তাঁর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। দুচোখে অন্ধকার দেখলেন তিনি। তাঁর সমস্ত চেতনা লোপ পেয়ে গেল। শেষবাব চেষ্টা করলেন দরজা আঁকড়ে ধরতে। সন্ন্যাসী বলে উঠলেন, ওঁকে ধরে। তাঁর গলার স্বর এত উচ্চগ্রামে ছিল যে অঞ্জলি চমকে গিয়ে শাশুড়িকে পড়ে যেতে দেখে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। অমরনাথ ছুটে এলেন। তিনিও মনোরমাকে আর এক পাশে ধরলেন। সন্ন্যাসী বললেন, ওঁকে ওখানে শুইয়ে দাও।
মনোরমাকে খাটের ওপর শুইয়ে দেওয়া হল। ঘরের কেউ মনোরমার এই আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ বুঝতে পারছিল না। অঞ্জলি দ্রুত পাখা নিয়ে এসে বাতাস করা শুরু করল। অমরনাথ মনোরমার ওপর ঈষৎ বুকে ডাকতে লাগলেন, মা, মা তোমার কি হয়েছে?
অঞ্জলি বলল, তুমি ডাক্তারবাবুকে খবর দাও।
সন্ন্যাসী বললেন, মুখে একটু জল দাও। ডাক্তারের প্রয়োজন হবে না। দীপা এতক্ষণ চুপচাপ সব লক্ষ্য করছিল। সন্ন্যাসীর উপদেশ শেষ হওয়ামাত্র সে জিজ্ঞাসা করল, আপনাকে দেখামাত্র ঠাকুমার এমন হল কেন?
সন্ন্যাসী গম্ভীর মুখে বললেন, এ থেকে প্রমাণিত হল মনের সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক রয়েছে। আমার ভাবতে ভাল লাগছে তোমার ঠাকুমার মনের কোন পরিবর্তন হয়নি।
এই সময় মনোরমা চোখ মেললেন। অঞ্জলি বুকে পড়ে জিজ্ঞাসা করল, মা, কি হয়েছে আপনার? শরীর খারাপ লাগছে?
মনোরমা জবাব দিলেন না। তাঁর নিঃশ্বাস দ্রুত পড়ছিল। অঞ্জলি আবার হাওয়া করতে চাইলে তিনি নিষেধ করলেন, থাক। তারপর চোখ বন্ধ করলেন। ঘরের কেউ কোন কথা বলছিল না। মিনিটখানেক চুপচাপ শুয়ে থাকার পর মনোরমা উঠে বসলো অঞ্জলির আপত্তি সত্ত্বেও। তাঁর চোখ এবার সন্ন্যাসীর দিকে। সন্ন্যাসীও চোখ ফেরাচ্ছিলেন না। মনোরমা বেশ রুগ্ন গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কে?
আমাকে দেখে যা মনে হয়। আমি তাই।
তাহলে এখানে এসেছেন কেন?
তুমি অসুস্থ। কথা বললে আরও উত্তেজিত হয়ে পড়বে।
সেটা আমি বুঝব। কেন এসেছেন?
সন্ন্যাসীরও সংসারের প্রতি কিছু দায় থাকে। সেই দায় মোটানোর প্রয়োজন হয়। পঞ্চাশ বছর সাধনার পর। তবে আমার আসার জন্যে কারো কোন ক্ষতি হোক আমি চাই না।
মনোরমা বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ সন্ন্যাসীকে দেখলেন। তারপর অঞ্জলির দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা সবাই এই ঘর থেকে যাও তো! আমি একা ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমি ডাকলে এ ঘরে এসো।
অঞ্জলি অমরনাথের দিকে তাকালে তিনি ইশারা করলেন আদেশ মান্য করতে। যদিও তাঁর এই রহস্যময় ব্যাপারে কৌতূহল বেড়ে যাচ্ছিল। অঞ্জলি দীপাকে ডাকলেন ঘর থেকে চলে আসবার জন্যে। ওরা সবাই চলে গেলে মনোরমা জিজ্ঞাসা করলেন, না, আমার ভুল হতে পারে না। আপনার প্রকৃত পরিচয় জানতে চাই। বলুন?
সন্ন্যাসী বললেন, প্ৰথমে বলে রাখি তুমি খেয়াল রাখবে যে হিন্দুঘরের বিধবা হিসেরে তোমার যা করণীয় তা থেকে সরে আসার কোন কারণ ঘটেনি। কোন গৃহী যখন সন্ন্যাসীব জীবন যাপন করেন তখন সংসারী মানুষের কাছে তিনি মৃত হয়ে যান। মনোরমা, তোমার অনুমান অভ্রান্ত। নৌকোড়ুবিতে আমার শারীরিক মৃত্যু ঘটেনি, আমাকে তুমি ঠিকই দেখছি। নদীতে ড়ুবে যাওয়ার পর কোথায় ভেসে উঠেছিলাম, কোন সাধুর প্রভাবে পড়ে আমি হিমালয়ে গেলাম। সেসব কথা এখন অবান্তর। নৌকোড়ুবিতে আমার সাংসারিক অস্তিত্বের মৃত্যু ঘটেছে। এবং সেই কারণেই তোমার এই বৈধব্যজীবন ধর্মমতে সঙ্গত।
মনোরমা থারথার করে কেঁপে উঠলেন। তারপর দু-হাতে মুখ ঢেকে যুঁপিয়ে উঠলেন। তাঁর কান্নার শব্দ সম্ভবত ভেতরের ঘরেও যাচ্ছিল। এবং আচমকা তিনি হাত সরিয়ে ভেজা চোখে বলে উঠলেন, বিশ্বাস করি না। আমার বাবা সব জায়গায় খবর নিয়েছিলেন। আমি যাঁকে বিয়ে করেছিলাম। তিনি অনেকদিন আগে ঈশ্বরের পায়ে চলে গিয়েছেন।
বেশ তো! আমি তোমাকে কিছুই বিশ্বাস করতে বলিনি। তোমাকে নিজে থেকে কোন কাহিনী শোনাইনি। আমার গলার স্বর শোনামাত্ৰ তুমি চৈতন্য হারালে—!
এই সময় ভেতর থেকে অমরনাথের গলা পাওয়া গেল, মা, কি হয়েছে, কাঁদছ কেন?
মনোরমা জবাব দিলেন না। সন্ন্যাসী বললেন, তোমার ছেলেকে এখানে আসতে বলো।
মনোরমা দ্রুত মাথা নাড়লেন, না। আপনি বুজাকক। আপনাকে আমি চিনি না। সন্ন্যাসী মাথা নাড়লেন, না। আমি বুজরুক নই। চিনতে চাইছ না। সেটা তোমার ইচ্ছে। পঞ্চাশ বছর পর সন্ন্যাসীকে এক দিনের জন্যে তার গহে ফিরে আসতে হয়—।
এসব কথা আমি শুনতে চাই না। মনোরমা উঠে দাঁড়ালেন। তারপর গম্ভীর ভঙ্গীতে ঘর থেকে বেরিয়ে ভেতরের ঘরে পা দিতেই অমরনাথের মুখোমুখি হলেন। অমরনাথ অত্যন্ত বিস্মিত। আজ পর্যন্ত তিনি মায়ের এই চেহারা দেখেননি। ইতস্তত না করেই তিনি প্রশ্ন করলেন, কি হয়েছে তোমার? কাঁদছিলে কেন খারাপ কিছু বলেছে না কি?
মনোরমা নিঃশব্দে মাথা নেড়ে না বললেন।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ঠিক আছে, দেখছি। অমরনাথ মনোরমার পাশ কাটিয়ে বাইরের ঘরে এসে হাত জোড় করলেন, কিছু মনে করবেন না। আপনার আচরণ আমাদের কাছে রহস্যময় ঠেকছে। আপনি বৃদ্ধ এবং সন্ন্যাসী। কিন্তু এর বেশী আমাদের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। তাছাড়া রাতও অনেক হয়েছে, এবার আপনি চলে গেলে খুশি হব।
সন্ন্যাসী বললেন, আমি এখানে থাকার জন্যে আসিনি। পথেঘাটে রাত কাটানোব অভিজ্ঞতা আমার আছে। সেই যোশীমঠ থেকে অনেক ঘুরে তোমাদে, ঠিকানা বের করে শেষ পর্যন্ত যে কারণে পৌঁছাতে পেরেছি তা সম্পূৰ্ণ হলেই আমি চলে যাব।
কারণটা তাড়াতাড়ি বলুন।
তুমি ঈশ্বরের নামে যে কোন খাদ্যবস্তু আমাকে দান কবো।
মানে? অমরনাথ আবার হতভম্ব।
তুমি মনোরমার পুত্র। অতএর এই দানের অধিকারী তুমিই।
কেন আমি আপনাকে দান করতে যাব? আপনি যদি অভুক্ত থাকেন তাহলে আমার স্ত্রীকে বলছি আপনাকে কিছু খাবার দিতে। অঞ্জলি– স্ত্রীকে গলা তুলে ডাকলেন অমরনাথ। অঞ্জলি কাছাকাছি ছিল। ডাক শুনে চটপট চলে এল। তাকে দেখে অমরনাথ বললেন, কিছু খাবার এনে ওঁকে দাও। নাটকটা শেষ হোক।
নাটক! সন্ন্যাসী হাসলেন, ঠিকই বলেছ, জীবন থেকে নাটক তৈরী হয়। কিন্তু অনেক সময় জীবন নাটককে ছাপিয়ে যায়। মা, তোমার বাড়িতে কোন ফল আছে? অঞ্জলি মাথা নাড়ল, না। সন্ন্যাসী জিজ্ঞাসা করলেন, অন্ন? ভাত?
শুধু ভাত?
হ্যাঁ।
সকালের রাঁধা কিছুটা রয়েছে।
তাই হবে। একটা পাত্রে তার সামান্য কিছু নিয়ে এস।
হঠাৎ অমরনাথ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন, দাঁড়াও। আপনি কি করতে চাইছেন?
আমার চাওয়াটা খুবই সামান্য অমরনাথ। সন্ন্যাস নিয়ে সংসার ত্যাগ করে গেলে কোন কোন গোষ্ঠীর সন্ন্যাসী যদি পঞ্চাশ বছর জীবিত থাকেন তাহলে তাঁকে এক দিনের জন্যে তাঁর সংসারে ফিরে এসে পুত্ৰ কন্যা অথবা স্ত্রীর হাতের দান গ্রহণ করতে হয়। নইলে তাঁর সাধনা সম্পূর্ণ হয় না। বলতে পার নিজের স্বার্থেই আমি তোমাদের কাছে এসেছি। সন্ন্যাসী খুব ধীর গলায় কথাগুলো বলে গেলেন।
অমরনাথের দুই চোখ বিস্ফারিত। তাঁর কথা বলার শক্তি লোপ পেয়ে গেল। কয়েক মুহুর্তের জন্যে। এই সময় অঞ্জলি চিৎকার করে উঠল, এ আপনি কি বলছেন?
আমি সত্যি কথাই বলছি মা।
না! তীব্র স্বরে শব্দটি উচ্চারণ করে মনোরমা দরজায় ছুটে এলেন, ওঁর কথা বিশ্বাস করো না বউমা, মিথ্যে মিথ্যে, সব বুজরুকি!
সন্ন্যাসী চোখ বন্ধ করলেন। সাদা দাড়ি গোঁফ সত্ত্বেও তাঁকে পাথরের মত দেখাচ্ছিল। অমরনাথ এবার চেতনায় এলেন, আপনি যা বলছেন তা দায়িত্ব নিয়ে বলছেন।
দেখো, তোমাদের কাছে আমার অন্য কিছু চাওয়ার নেই। না। টাকা পয়সা, না বিষয সম্পত্তি। মিথ্যাচার করে আমি কি পেতে পারি? এখনই এই রাত্রে আমি চলে যাব। হয়তো এই জীবনে তোমাদের সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। আমার গোষ্ঠীর নিয়ম পালন করতেই তোমাদের বিরক্ত করতে এসেছি। তোমরা অসংযত হয়ে না।
হঠাৎ অত্যন্ত অসহায় হয়ে পড়লেন অমরনাথ। তিনি বুঝতে পারছিলেন না কি করবেন! এই বৃদ্ধ সন্ন্যাসী তাঁর পিতা? যে মানুষটিকে জন্মইস্তক মৃত বলে জানেন তিনি তাঁর সামনে বসে দান চাইছেন? পিতৃস্নেহের প্রতি তাঁর লোভ ছিল ছেলেবেলা জুড়ে। বন্ধুদের প্রত্যেকের বাবা ছিল শুধু তাঁর নয়। সেই মানুষটিকে আজ সামনে পেয়ে–। না, মনোরমা স্বীকার করেননি এখনও। বাবার চেহারার যে বৰ্ণনা তিনি শুনেছেন তার সঙ্গে সন্ন্যাসীর বয়স সত্ত্বেও কিছু মিল রয়েছে। তিনি চোখে দেখেননি। কিন্তু চিনতে যদি কেউ পারেন তিনি হলেন মনোরমা। অমরনাথ মায়ের দিকে ঘুরে কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলেন, মা, তুমি বল, ইনি আমার বাবা?
মনোরমা মুখে আঁচল চাপা দিলেন।
অমরনাথ বললেন, মা, তুমি চুপ করে থেকে না। যদি ইনি মিথ্যা কথা বলেন তাহলে যাতে এই চা-বাগান থেকে সশরীরে না বেরুতে পারেন তার ব্যবস্থা আমি করার।
মনোরমা অস্ফুট বললেন, না।
অমরনাথ উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি স্পষ্ট বল মা, এটা সত্যি?
মনোরমা সেই অবস্থায় মাথা নাড়লেন, আমি জানি না। তার মুখ থেকে আবার কান্না ছিটকে উঠল। এবং এতক্ষণ চুপচাপ দেখে গিয়ে দীপা ঘরের মাঝখানে এগিয়ে এল, তোমরা একটু চুপ কর। শুনুন, আপনি যে পরিচয় দিচ্ছেন তার সপক্ষে কোন প্রমাণ আছে?
সন্ন্যাসী মাথা নাড়লেন, না নেই। ধরে মা, তোমাকে এখান থেকে তুলে যোশীমঠে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে কেউ কখনও তোমাকে দেখেনি। হঠাৎ যদি কেউ তোমাকে সেখানে বলে যে তুমি কে প্রমাণ দাও। তাহলে দিতে পারবে? তোমার ঠিকানা নাম যতই বল তাতে তো তুমি এই তুমি প্ৰমাণিত হবে না। যতক্ষণ না সেটার সত্যাসত্য পরীক্ষা করতে কেউ এখানে আসে। তাই না? পরিচিত মানুষ-সমাজ থেকে আমরা চলে গেলে পরিচয় প্ৰমাণ করা বড় শক্ত হয়ে পড়ে।
দীপা সন্ন্যাসীর.. কথা মন দিয়ে শুনে জিজ্ঞাসা করল, তাহলে আপনার পরিচয় জানতে যোশীমঠে যেতে হবে। আমাদের? ব্যাপারটা কি আদৌ বাস্তব?
ঠিকই বাস্তব নয়। তাহলে আর একটা উপায় থেকে যাচ্ছে। সেটা হল যিনি চিনতে পারবেন। অথাৎ একমাত্র পূর্বপরিচিত ব্যক্তিই শনাক্ত করতে পারেন।
এখানে আপনার পূর্বপরিচিত কেউ নেই। বাবাও পঞ্চাশ বছর আগে জন্মাননি। ঠাকুমাও যে কথা বললেন, তা আপনি শুনেছেন।
শুনেছি।
এত রাত্রে আপনি কোথায় যাবেন?
পথে বের হবার আগে পথ নিয়ে কি কোন সন্ন্যাসী চিন্তা করে মা?
যিনি সম্পূর্ণ বর্জন করতে পারেন—।
সন্ন্যাসীদের স্বার্থপর হতে হয়?
এক অর্থে তুমি সত্যিা বলছি।
নিজের স্বার্থ ছাড়া যারা চিন্তা করতে পারে না তারা কি ধরনের মানুষ?
বিচার করতে হবে কোন স্বাৰ্থ? ঈশ্বরচিন্তায় মগ্ন হয়ে পার্থিব সম্পর্ক থেকে যিনি গুটিয়ে নেন নিজেকে তাঁর সঙ্গে ধনলোভী স্বার্থাম্বেষী তুলনা করা কি ঠিক?
ঈশ্বর চিন্তায় মগ্ন থেকে যিনি নিজের পারিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন হন তিনি কি একই ঈশ্বরকে পেতে চান না? তার স্ত্রীপুত্র যদি ভেসে যায়। তবু তিনি নিজের পুণ্যোব জােনা সন্ন্যাসী হয়ে দিন কাটান না? অর্থাৎ ঈশ্বরকে পেতে তিনি একাই চান নিজের স্বার্থসিদ্ধি করতে। তফাতটা কোথায় আমি বুঝতে পারছি না।
এই সময় অমরনাথ ধমকে উঠলেন, দীপা! এত কথা বলার কোন দরকার নেই।
আর মনোরমা বললেন, না। অমর। দীপা ঠিকই বলছে।
খুব অবাক হয়ে গেল দীপা। যে ঠাকুমা দিনরাত ঠাকুর পুজো আর বস্তাপচা সংস্কার আঁকড়ে থাকেন তাঁর মুখ থেকে এমন কথা সে শুনবে ভাবতে পারেনি। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ঠাকুমা, ভাল করে চেয়ে দেখো তো, ইনি তোমার স্বামী ছিলেন?
মনোরমা জবাব দিলেন না। দীপা একবার বাবার দিকে তাকাল। তারপর বুলল, বাবা, ঠাকুমার কাছে ঠাকুর্দার অনেক গল্প শুনেছি। ওঁর  বা দিকের বুকে একটা বড় আচিল ছিল। ছোটবেলায় সেটা কাটতে গিয়ে ঘা করে ফেলেছিলেন। এই নিয়ে ঠাকুমা তাঁকে খুব ক্ষ্যাপাতেন। তুমি দেখবে সেই দাগটা ওঁর শরীরে রয়েছে কিনা?
মনোরমা বললেন, আঃ। তোমরা থামবে? আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না কেন?
অমরনাথ এক পাও এগোলেন না। সন্ন্যাসী হাসলেন। তারপর তীর আলখাল্লার বাঁধন খুলে উধ্বাঙ্গের কিছুটা উন্মুক্ত করে বললেন, সম্ভবত এই দাগটির কথাই উনি তোমাকে বলেছিলেন।
তাঁর কথা শেষ হওয়ামাত্ৰ মনোরমা ছিটকে বেরিয়ে গেলেন ঘরের বাইরে। অমরনাথ কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন চেয়ারে। অঞ্জলি দ্রুত শাশুড়িকে অনুসরণ করল।
দীপা বলল, আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন।
ঠিক হল না। এই চিহ্ন যে কােন মানুষের শরীরে থাকতে পারত। কাকতালীয় ভাবে সে যদি তোমাদের কাছে মিথ্যে বলতে এসে সেটা দেখাতো তাহলে এত তাড়াতাড়ি তাকে স্বীকার করা কি ঠিক?
দীপা মাথা নাড়ল, না। আর কোন প্রমাণের দরকার নেই।
কেন? সন্ন্যাসীর চোখে কৌতুক।
ঠাকুমার আচরণ প্ৰমাণ করছিল। তিনি আপনাকে চিনতে পেরেছেন?
তুমি তো অসাধারণ বুদ্ধিমতী।
তাতে কিছু লাভ হচ্ছে না। কিন্তু এটা কি আপনি ঠিক করলেন! একটি মানুষ এতকাল ধরে জেনে এসেছেন যে তিনি বিধবা। তাঁর সমস্ত সত্তায় সেই ধারণা বসে গিয়েছে। এতদিন বাদে তিনি এই আঘাত কি করে সহ্য করবেন?
আমি তো তাঁর কাছে মৃত।
কিন্তু সেটা এখন তো সত্যি নয়।
কেন নয়! আমার সাংসারিক সত্তা তো সেই করে মরে গিয়েছে।
এটা আপনি যেভাবে ভাবতে পারেন ঠাকুমা তা পাববেন কেন? তিনি আপনার শ্ৰাদ্ধ পর্যন্ত করেছেন ও আমি বুঝতে পারছি না কি হবে?
ঠিকই বলছি তুমি? মৃত মানুষ ফিরে এলে মানুষের সুখের বদলে দুঃখ বাডে। আমি নিজের কথাই ভাবতে গিয়ে এ দিকটা চিন্তা করিনি।
কিন্তু নৌকোড়ুবির পরে আপনি কি করে সন্ন্যাসী হলেন? ঠাকুমার কথা আপনার মনে পড়েনি? তাঁকে বঞ্চিত করে যাচ্ছেন একথা মনে হয়নি?
না। কারণ যে সাধু আমাকে প্ৰাণে বাঁচিয়েছিলেন, দীর্ঘদিন অসুস্থ হয়ে তাঁর কাছে থাকার পরে জানতে পেরেছিলাম। তিনি হিমালয়ে ফিরে যাচ্ছেন। আমি তার অনুমতি নিয়ে গ্রামে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে জেনেছিলাম তোমার ঠাকুমা ইতিমধ্যে শ্ৰাদ্ধ করে বৈধব্যজীবন যাপন করতে আরম্ভ করেছেন। কেমন ধিক্কার এল মনে। আমি পৃথিবীতে বেঁচে আছি। অথচ আমার প্রিয়জনেরা মৃত ভেবে নিয়ে তাঁদের মত জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। সেই মানসিকতায় আমি সাধুব কাছে ফিরে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন হিমালয়ে। ওঁকে যদি কেউ বঞ্চিত করে থাকেন তাহলে তিনি ঈশ্বর। আমি নই। সন্ন্যাসী কথা শেষ করতেই ঘড়িতে শব্দ বাজল। রাত গম্ভীর হচ্ছে। সন্ন্যাসী অমরনাথের দিকে তাকালেন।
অমরনাথ বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে এতক্ষণ কথাবার্তা শুনছিলেন। এবার চোখাচৌখি হতে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন, বাবা?
সন্ন্যাসী উত্তর দিলেন না। অমরনাথ এগিয়ে এলেন দুই হাত জোর করে, বাবা, আমাকে ক্ষমা করুন।
তুমি স্বাভাবিক আচরণ করেছ অমরনাথ। এখন কি তোমার কাছে দান পেতে পাবি?
বাবা, আপনি যেতে পারবেন না।
মানে?
আপনাকে আমাদের কাছে থাকতে হবে। অমরনাথের গলার স্বর কাঁপছিল।
অসম্ভব। সন্ন্যাসী কখনও গৃহবাসী হতে পারে না। আপনাকে আমরা পেতে পারি না বাবা? না। সন্ন্যাসী বললেন, আমার প্রার্থনা এবার পূর্ণ কর অমরনাথ।
বাবা। এ জীবনে আপনার দর্শন এভাবে পাব। কখনও ভাবিনি। আমার অনেক সমস্যা। পিতা হয়ে আমাকে কিছু উপদেশ দিয়ে যান। দয়া করে। আজ রাতটা অন্তত থাকুন
না। রাত্রিবাস করা সম্ভব নয়।
কিন্তু এখানে কোন হোটেল দূরের কথা ধর্মশালা পর্যন্ত নেই।
সেই চিন্তা তোমার নয়। সন্ন্যাসী হাসলেন, তোমার নিজস্ব জীবনযাত্রা বলে দেবে সমস্যায় পড়লে তোমার কি ধরনের আচরণ হওয়া উচিত। সংসারী জীবন এবং তার সমস্যা সম্পর্কে কোন আগ্রহ আমার আর অবশিষ্ট নেই।
অমরনাথ ঠোঁট কামড়ালেন। তারপর ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সন্ন্যাসী দীপার দিকে তাকালেন, তোমার নামটি কি যেন?
দীপাবলী।
বাঃ। আলোকিত কর। নিজেকে প্ৰকাশ কর।
কি ভাবে?
নিজের চারপাশের অন্ধকার দৃব করে। আমি অনুমান করছি তোমার বিবাহ হয়েছিল। তোমার স্বামী বিগত। কিন্তু এখন এই বয়সে–, বিভ্রম হচ্ছে।
আমার বাবা বোধ হয় এই ব্যাপারে। আপনার উপদেশ চাইছিলেন। ওঁরা কেন যে বালিকা অবস্থায় আমার বিয়ে দিলেন তা এখনও আমি বুঝতে পারিনি। বিয্যের দুদিন বাদেই সেই ছেলেটি অসুস্থতায় মারা গেল। তার বাবার হাত থেকে আমি কোনমতে রক্ষা পেয়ে চলে এসেছিলাম। তার দীর্ঘদিন বাদে যখন কলেজে ভর্তি হলাম তখন জানতাম না যে সেই ভদ্রলোক প্ৰায়শ্চিত্ত করার জন্যে আমার বাবার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে ব্যাঙ্কে আমার নামে টাকা রেখেছিলেন যাতে আমি পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারি। খবরটা ওর মৃত্যুর পরে আমি জেনেছি। জানাব পর ওঁর নোংরা টাকাব্য আর পড়াশুনা করতে আমি রাজী নই। জলপাইগুড়ি শহরের কলেজ থেকে আজ আমি চলে এসেছি।
সন্ন্যাসী হাসলেন, যা ভাল মনে করেছ তাই হয়েছে।
দীপা বলল, কিন্তু আমাকে সবাই বোঝাতে চাইছেন আমি ভুল করছি।
তাদের নিশ্চয়ই বোঝাবাব অধিকার আছে। সন্ন্যাসী উঠে দাঁড়ালেন, অমরনাথ কি করবে? বলতে না বলতে অমরনাথ এবং অঞ্জলি ফিরে এলেন। আমন্ত্ৰ  থৈর হাতে একটি থালায় রাতের খাবার। তিনি বললেন, আপনি হাত মুখ ধুয়ে তারপর নিশ্চয়ই এসব গ্ৰহণ করবেন?
সন্ন্যাসী বললেন, তার প্রয়োজন হবে না। এত কেন এনেছ? আমি সামানা অন্ন চেয়েছি তোমার কাছে। তুমি ওই থালা থেকে একমুঠো। আমার হাতে তুলে দাও।
আপনি আমার এখানে রাতেব খাবার খাবেন না?
না। সন্ন্যাসী দুটো হাত অঞ্জলির মত এগিয়ে ধরেও সরিয়ে নিলেন। তিনি দীপার দিকে তাকালেন, শোন মা। তুমি পথিক, পথ তোমার। সেই পথ রাজা তৈরী করেছেন না কোন অসৎ ধনীর টাকায় তৈরী হয়েছে তা তো তোমার জানার কথা নয়। পথিকের কাজ পথ ধরে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া। শরীরের জন্যে জীবন নয়, জীবনের জন্যে শরীর। লক্ষ্যে পৌঁছে পথিক পায়ের ধুলো ধুয়ে ফেলে জলে। সেটাই তো উচিত। পথ পড়ে থাকে পথে। সন্ন্যাসী আবার অমরনাথের দিকে ফিরলেন, দাও।
তাঁর বাড়ানো দুই হাতের চেটোয় এক মুঠো অন্ন তুলে দিলেন অমরনাথ। সন্ন্যাসী মনে মনে কিছু বললেন। তাঁর দুটো ঠোঁট কাপছিল। সযত্নে ওই অন্ন তিনি নিয়ে বেরিয়ে এলেন বারান্দায়। নেমে দাঁড়ালেন অন্ধকার আকাশের নিচে। তারপর মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে সেই অন্ন ছড়িয়ে দিতে লাগলেন মাটি, জল, আলো, বাতাস এবং আকাশের উদ্দেশে। হ্যারিকেনের আলোর যে সামান্য অংশ বাইরে আসতে পেরেছিল তাতে তাঁকে খুব রহস্যময় মনে হচ্ছিল। উৎসর্গ শেষ হলে তিনি যখন স্থির হলেন তখন অমরনাথ এবং অঞ্জলি তাঁর পায়ের সামনে নতজানু হলেন। সন্ন্যাসী হাত তুলে আশীর্বাদ করে ধীরে ধীরে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে আসাম রোডের দিকে এগিয়ে চললেন। আর তখন অমরনাথ ড়ুকরে কেঁদে উঠলেন। অঞ্জলি তাঁকে বলল, তুমি ওঁকে চলে যেতে দিচ্ছ? তোমার বাবা না? যাও, আটকাও। মায়ের কথা ভাবতে পারছি? উনি চলে গেলে ওঁর কি হবে?
অমরনাথ বললেন জড়ানো গলায়, থাকলে কি ভাল হবে অঞ্জলি?
অঞ্জলি সেটা বুঝতে চাইল না, স্বামীকে পঞ্চাশ বছর পরে ফিরে পেতে স্ত্রীর ভাল লাগবে না? কি যাতা বলছ? তাছাড়া এত রাত্রে এই জঙ্গুলে জায়গায় উনি কোথায় থাকবেন?
দীপা চুপচাপ শুনছিল। তার চোখের সামনে একটি মানুষ বংশধরের কাছ থেকে অন্নের ডেলা গ্ৰহণ করে পঞ্চভূতে ছড়িয়ে দিয়ে নির্বিকারভাবে চলে গেলেন। এই সংসার এই অন্ধকার কোন কিছুই তাঁর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারল না। সে বলল, মা, বাবা ঠিকই বলেছেন। ওঁকে ডেকে কোন লাভ হবে না।
দীপা ভেতরে চলে এল। বসার ঘর শোওয়ার ঘর পেরিয়ে উঠোনের বারান্দায্য পৌঁছে মনোরমার ঘরের দিকে তাকাল। দরজা ভেজানো। আলো জ্বলছে। সে নিঃশব্দে দরজা খুলল। মনোরমা বসে জপ করছেন, রোজ যেমন করেন। ঠাকুমার পুজো এর আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে বলে সে জানত। দীপা খাটের ওপর বসল।
তার চোখের সামনে এক বৃদ্ধার টানটান শরীর, যে শরীরে কম্পন নেই। একমাত্র একবার কেঁদে ওঠা ছাড়া ঠাকুমা সমানে অস্বীকার করে গিয়েছেন ঠাকুর্দার অস্তিত্ব। যাওয়ার সময় ঠাকুর্দা ভুলেও ওঁকে ডাকেননি। উনি জানেন না এখনও, ঠাকুর্দা চলে গিয়েছেন। সত্যি কি ঠাকুমা মনে করছেন উনি ঠাকুর্দা নন! কিন্তু কি স্বাৰ্থ নিয়ে মানুষটা এখানে আসবেন? মনোরমা যেভাবে বসে আছেন তাতে মনেই হচ্ছে না কোন কিছু তাঁকে আলোড়িত করেছে। পুজোর সময় তাঁকে ডাকা নিষেধ। দীপা অপেক্ষা করতে লাগল।
এ বাড়ির কোথাও কারো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। অন্তত আধঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর প্ৰণাম সেরে মনোরমা উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর নজর পড়ল দীপার ওপর। দীপা তাঁর চোখের দিকে তাকাল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, তুমি বিশ্বাস করো উনি ঠাকুর্দা নন।
নিশ্চয়ই। মনোরমা জবাব দিলেন।
কিন্তু উনি তো প্ৰমাণ দিলেন।
কিসের প্রমাণ? বুকের দাগ আর অতীতের গল্প গ্য তাতে কি হয়েছে? এই যে আমি পঞ্চাশ বছর ধরে বৈধব্যজীবন পালন করছি সেটা মিথ্যে হয়ে যাবে এক নিমেষে? আমার বাবা পঞ্চাশ বছর আগে অনেক খবর নিয়ে জেনেছিলেন তিনি মারা গিয়েছেন। আজ ভূতের মত বেঁচে ফিরে এলেই হল? উঃ, আর কত বুজরুকি দেখব!
তাহলে তুমি কাঁদলে কেন? কেন চলে এলে?
আমি সহ্য করতে পারছিলাম না।
কিন্তু ধরে ঠাকুর্দা তখন মারা যান নি, আজ সত্যি উনি ফিরে এসেছেন  কে বলল। মারা যায়নি! যখন মানুষের মন থেকে টান চলে যায়। তখন সে বেঁচে থাকে না কি, নে ওঠ, খেয়ে নে।
অবাক হয়ে তাকিয়েছিল দীপা। তার মনে হল। ঠাকুমা ঠিকই বলছেন। ঠাকুর্দা যদি ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্যে পঞ্চাশ বছর ধরে স্বার্থপরতা দেখান, যদি আজ সংসারে এক মুহুর্তের জন্যে এই ফিরে আসাটা স্বার্থের কারণে হয়ে থাকে তাহলে ঠাকুমা ঠিকই করেছেন তাঁর অস্তিত্ব অস্বীকার করে। সে বলল, দাঁড়াও!
দীপা মনোরমাকে প্ৰণাম করল। মনোরমা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হঠাৎ থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। দীপা ফিসফিস করে বলল, তুমি শক্ত হও ঠাকুমা, তুমি একজন সন্ন্যাসীর চেয়েও অনেক বড়। একটু শান্ত হয়ে মনোরমা জিজ্ঞাসা করলেন, তুই কলেজে ফিরে যাবি তো?
দীপা মাথা নাড়ল, যাব। মনে মনে সে উচ্চারণ করল, পথ তুমি কার? পথিকের।