সাতকাহন (১ম পর্ব)
– সমরেশ মজুমদার
সাতকাহন, উপন্যাসটির সূচনা, বিস্তৃতি আর প্রবাহধারা একজন নারীকে নিয়ে । যার নাম দীপাবলি বন্দ্যোপাধ্যায়। আপাত দৃষ্টিতে এই উপন্যাসটিকে শুধু মাত্র একজন নারীর গল্প মনে হলেও, দীপা হলো বাঙালী সেই সব নারীদের প্রতিনিধি যাদেরকে এই পুরুষ শাসিত সমাজ কখনো সংস্কার, কখনো দুর্বলতা আবার কখনো লালসার ভয় দেখিয়ে হতাশার কাল কুঠুরিতে ছুড়ে ফেলতে চায়, কিন্তু দীপারা দমে না, হারে না। সমাজের চোখ রাঙ্গানি উপেক্ষা করে চলতে থাকে তাদের নিরন্তর যুদ্ধ। মায়ের মৃত্যুর পর জন্মদাতা পিতার কাপুরুষতায় দীপার আশ্রয় মেলে তার মাসি-মেসোর সংসারে। না, অপরের সন্তান মনে করে নয়, শুরুতে নিজের সন্তানের মত ভালবাসা আর আদর দিয়েছিল অঞ্জলি আর অমরনাথ। নিজের দুইটা পুত্র সন্তানের সাথে এই কন্যাটিকে বুকে টেনে নিয়েছিল ওরা। অমরনাথের মা মনোরমাও কখনো দীপাকে আলাদা করে দেখতে চাওনি। কিন্তু বৈধব্যের সংস্কারের কারণে নারী পুরুষের ভেদাভেদের চেতনায় মনোরমা সারাক্ষন দীপাকে আবদ্ধ রাখতে চাইত। মাষ্টার সত্যসাধনের বাবু তার অভিজ্ঞ চিন্তা শক্তি দিয়ে দীপার মাঝের মেধাবী সও্বাকে সহজেই চিনে নিয়েছিলেন। আর সেজন্য নিঃসন্তান এই মানুষটির দীপাকে নিয়ে স্বপ্ন দানা বাধে। কিন্তু সমাজের ঘুনেধরা সংস্কারগুলো দীপার পরিবারের মানুষগুলো পিছু ছাড়ে না । মাত্র এগার বছর বয়সে এক বিত্তবান ঘরের নিঃশেষিত রুগ্ন ছেলের সাথে দীপার বিয়ে হয়। এই অসুস্থ সমাজের চোখে একটি মেয়ের বিয়ের যোগ্যতা বিচার করা হয় তার মানসিক পূর্নতা নিয়ে নয়, তার ঋতুর সক্ষমতা নিয়ে। দীপারও তাএর ব্যতিক্রম হয় না । কিন্তু বিয়ের পর মাত্র একটা রাতে জন্য সে বধূ হয়ে থাকতে পারে। ঐ একটিরাতে দীপার সাথে কি হয়েছিল নিঃসন্দেহে পাঠকদের হৃদয়ে ঘটনাগুলো আলোড়িত করে তুলবে। বিয়ের পরের দিনই দীপার স্বামী মারা যায় আর দীপাকে, মাত্র এগারো বছরের একটা বাচ্চাকে একা পাঠিয়ে দেয়া বাপের বাড়িতে । দীপার জীবনের বিভীষিকাময় রাতের পর শুধু দীপার স্বামীর মৃত্যু হয়নি, আরেকটি মৃত্যু হয়েছিল, যেটি ছিল একটি হত্যা। দীপার শৈশবিক সত্তার হত্যা হয়েছিল সেই রাতে। কেউ শুনে নি, কেউ জানতে পারেনি। দীপার এই প্রত্যাবর্তনে অমরনাথ তার ভুল বুঝতে পারেন। দীপার পড়াশোনা আবার শুরু করা হয়। তবে সেই প্রাণোচ্ছ্বল, হাসি-খুশী দীপাকে এ বাড়ির আর কেউ কখনো দেখতে পায়নি। সে যেন এক প্রস্তর খন্ড। মনোরমাও দীপার উপর নির্মম বৈধব্য চাপিয়ে দিলেও দীপা কোন প্রতিবাদ করে না । কিন্তু সে শুরু করে নতুন এক যুদ্ধ। পড়াশোনায় নিজেকে উজাড় করে খোজে মুক্তির পথ। মাধ্যমিক মেধাবী ফলাফল করে জলপাইগুড়িতে ভর্তি হয় উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য। তাই এই সংগ্রামে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছিলেন অমরনাথ। উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডিও পার হতে দীপাকে খুব বেশি অসাধ্য সাধন করতে হলো না । কিন্তু কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হবার পরে অমরনাথ দীপাকে ছেড়ে চলে যান। আর অমরনাথের এই স্বাভাবিক মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেনি অঞ্জলি। তার মৃত্যূর জন্য দায়ী করা হলো দীপাকে। দীপাকে তার পরিবারের ছায়া থেকে বের করে দেওয়া হলো। দীপ সম্পূর্ণ একা হয়ে গেল, পাশে এসে দাড়াবার মত খুজে পেল না কাউকে। তবু দীপা কি পেরেছিল এই সমাজে হিংস্র আর স্বার্থান্বেষী শকুনের ভিড়ে নিজেকে রক্ষা করতে? পেরেছিল নিজেকে সেই শিক্ষার আলোয় নিজেকে ভাসাতে যে আলো তাকে মুক্তি দেবে? জানতে হলে, হাটতে হবে কিছুটা পথ দীপাবলির সাথে। পাঠ্য প্রতিক্রিয়াঃ আমি চিত্রাঙ্গদা। দেবী নহি, নহি আমি সামান্যা রমণী। পূজা করি রাখিবে মাথায়, সেও আমি নই; অবহেলা করি পুষিয়া রাখিবে পিছে সেও আমি নহি। যদি পার্শ্বে রাখো মোরে সংকটের পথে, দুরূহ চিন্তার যদি অংশ দাও, যদি অনুমতি কর কঠিন ব্রতের তব সহায় হইতে, যদি সুখে দুঃখে মোরে কর সহচরী আমার পাইবে তবে পরিচয়। রবীন্দ্রনাথের কাব্যের চিত্রাঙ্গদাকে যারা পড়েছেন, যারা খুজেছেন তারা সেই চিত্রাঙ্গদাকে দীপাবলির মাঝে দেখতে পাবেন। দীপাবলি বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের এমন এক শক্তিশালী নারী চরিত্র, যাকে না জানলে, না চিনলে, পাঠকদের পাঠ্য জগতে একটা শূন্যতা থেকে যাবে । এক সাধারণ কিশোরীর অসাধারণ নারী হয়ে ওঠার উপ্যাখান হলো সাতকাহন। লেখক সমরেশ মজুমদার তার কলমের ছোয়ার যে নারীর কল্পছায়া আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন, সেটা নিঃসন্দেহে যর্থাথ এবং সাবলীল।
০১. আজ সারাটা দিন সূর্যদেব উঠলেন না
সাতকাহন – সমরেশ মজুমদার (ধীরে ধীরে আপডেট করা হচ্ছে)...০২. মেয়েরা কি ভূত হয়
সকাল নটায় জলখাবার খেয়ে ধুতি আর পুরো-হাতা শার্ট পরে নিলেন অমরনাথ। এইসময় তাঁর খুব আরাম লাগে। একজোড়া বিদ্যেসাগরী চটি আছে। তিন বছর অন্তর কলকাতায় বেড়াতে গিয়ে কলেজ স্ট্রীট থেকে কিনে আনেন। সপ্তাহে ছদিন তো কেডস আর হাফপ্যান্ট পরে কাটাতে হয় চায়ের বাগানে। সন্ধের পরে তাসের আড্ডায়...০৩. ভালো-মন্দ বোঝার বয়স
এক দেশলাই বাক্স ফড়িং আর এক কোটো কেঁচো নিয়ে ওরা তিনজন যখন কোয়াটার্সের পেছন দিয়ে নিজেদের লুকিয়ে চা-বাগানের ভেতর ঢুকে পড়ল তখন আকাশেব মেঘের গায়ে ফাটল দেখা দিয়েছে। সূর্যদেবের হদিশ নেই। কিন্তু তিনি এখন মধ্যগগন অতিক্রম করেছেন সেটা বোঝা যাচ্ছে। যদিও চা-বাগানের ভেতর এখন একটা...০৪. রমলা সেন
মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল অমরনাথের। শেষ হাতে নবনীর দোষে হেরে গেলেন তিনি। নবনী তাঁদের বাগানের মেজগুদামবাবু। খুব উৎসাহ তাস খেলার অথচ শেষ সময়ে মাথা ঠিক রাখতে পারে না। মাত্র চারটে বঙ পেয়ে বারো পয়েন্টেই ডবল দিয়ে বসল থ্রি স্পেড্সে। প্রতিপক্ষ ওটি করে জিতে গেল। তা না হলে...০৫. সত্যসাধন মাস্টার
সত্যসাধন মাস্টার প্রতি সন্ধ্যায় দীপাকে পড়াতে আসবেন। মাসান্তে তাঁকে দশ টাকা দিতে হবে। ব্যাপারটা মনোরমার পছন্দ হয়নি। তাঁর স্মরণে পড়ে না কখনও পরিবারের কাউকে পড়ানোর জন্যে মাস্টার এসেছে কিনা। এমন কি অমরনাথের ছাত্রাবস্থায্য মাস্টারের প্ৰযোজন হয়নি। ব্যাপারটা তিনি সরাসরি...০৬. বৃষ্টিটা চলে যাওয়ার পরে
বৃষ্টিটা চলে যাওয়ার পরেই ফিনফিনে শীতের দিন শুরু হয়ে গেল। চা-বাগানের গাছের পাতা রঙ পাল্টাচ্ছে আকাশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। একটা রুক্ষু ভাব মাখামাখি চারপাশে। এখন সূর্য ড়ুবলেই চোরা পায়ে ঠাণ্ডা নেমে আসে আকাশ থেকে। রাত নটাতেই সেটা টের পাইয়ে ছাড়ে। রোদে গরম করে রাখা লেপ কম্বল...
০৭. চারদিন পৃথিবীটাকে দ্যাখেনি দীপা
চারদিন পৃথিবীটাকে দ্যাখেনি দীপা। এই চারদিনে কালীপুজো হয়ে গেল, তার ভাসানও শেষ হল। অথচ একটি বারের জন্যেও দীপা যেতে পারেনি মণ্ডপে। মণ্ডপে কেন, দিনের আলোয় সে বেরিয়ে আসেনি মনোরমার ঘর থেকে। প্রথম দিন প্রচুর কান্নাকাটি, চিৎকার করেও যখন কাজ হয়নি তখন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল সে।...
০৮. দীপাবলীর বিয়ে
প্রথম দিন জল পর্যন্ত ছুঁয়ে দ্যাখেনি মেয়ে, খাবার তো দূরের কথা। কেঁদে কেটে গলা ভেঙেছে। তখন বাড়িতে ঢুকলে মনে হত সদ্য কারো বিয়োগ ঘটেছে। এখন চুপচাপ। বলা যায় বেশী রকমের চুপচাপ। একমাত্র প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া মনোরমার ঘর ছেড়ে বেরুচ্ছে না সে। ক্ষুদে দুটো কথা বলতে চেষ্টা করে...
০৯. বাসর এবং বউভাত
মেয়েটা এক ফোঁটাও কাঁদল না। অঞ্জলি যখন তাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল তখন সে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পরনে বেনারসীতে সে বেশ জবুথবু, মাথার মুকুট সাইজের চেয়ে সামান্য বড় হওয়ায় একটু বেঢপ লাগছে। কিন্তু এসবে তার কোন প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল বলে মনে হল না। ওপাশে মনোরমা কাঁদছিলেন...
১০. দীপাবলীর ফুলশয্যা
নটা বাজতে না বাজতেই বিয়েবাড়ি ফাঁকা হয়ে গেল। একেই শীতের রাত তার ওপর শহরটার নাম জলপাইগুড়ি। গরমকালে এখনও রাত্রে বিকশা পাওয়া যায় কিন্তু শীত পড়লেই সন্ধে গড়ালে তারা উধাও হয়ে যায়। আর রিকশা ছাড়া ঘোরাফেরার অন্য কোন যান এখানে নেই। শহরে চীফ মিনিস্টারের উপস্থিতিও খুব একটা কাজ...
১১. পুত্ৰটি দেহ রেখেছে
সারাটা সকাল একা এই ঘরে, দুপুর এখন খানখান। দীপার কাছে কেউ আসেনি। এমন কি মুখ ধুতে অথবা বাথরুমে পৌঁছে দিতেও না। পুরো বাড়িটাই যেন মুক হয়ে রযেছে সেই সকাল থেকে যখন অতুলচন্দ্রকে ওরা হাসপাতালে নিয়ে গেল। ঘরের এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল দীপা! প্ৰথমে প্রতুলবাবু ছুটে এসেছিলেন। আর...
১২. রমলার চিঠি
স্নেহের দীপাবলী, তোমার চিঠি পেয়েছি। তোমাকে আমি ইংরেজিতে চিঠি লিখতে বলেছিলাম। অথচ সেটা পেয়ে আমি বাংলায় কেন লিখছি তাই ভেবে নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছ। সেইটে আগে বুঝিয়ে বলি! আমাদের সময় আমরা ইংরেজিটা বাংলার চেয়ে ভাল শিখতাম। কোন কিছু বানিয়ে লিখতে বললে বাংলার বদলে ইংরেজিতে লিখলে...
১৩. প্ৰাপ্তবয়স্কতা শরীরের না মনের
অমরনাথ রিকশাওয়ালাকে থামতে বললো। তিনি লোকটাকে চিনতেই পারছিলেন না। রোগা লম্বা প্রৌঢ় এবং পোশাকে অসাচ্ছল্যর ছাপ স্পষ্ট। কাছে এসে লোকটি দুই হাত যুক্ত করে মাথায় ঠেকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ভুল করেছি কি? আপনি অমরনাথবাবু? আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনার ভুল হয়নি। তা যাচ্ছেন কোথায়? সঙ্গে পরিবার...
১৪. চাবাগানের আশেপাশে
চাবাগানের আশেপাশে যে-সমস্ত সরকারি জমি খালি পড়েছিল সেগুলোর দিকে কেউ নজর দিত না। বার্নিশঘাট পেরিয়ে লঙ্কাপাড়া অথবা হয় ময়নাগুডি লাটাগুডি নয় রানারহাট হয়ে সেবক পর্যন্ত আর ওদিকে কুচবিহার আলিপুরদুয়ারে যাওয়ার পথে দুপাশে তাকালে হয় জঙ্গল নয় বুনো ঝোপ আর ফাঁকা মাঠ চোখে পড়বে।...
১৫. আসাম রোড
আসাম রোড যেখানে চা-বাগানের সীমা ছাড়িয়ে বা দিকে বাঁক নিয়েছে সেখানে গতরাত্রে বাঘ এসেছিল। দু-তিনঘর মদেশিয়া সেখানে বাসা বেঁধেছিল। এরা এককালে চা-বাগানেই কাজ করত। চাকরি শেষ হবার পর সাহেব দয়া করে ওই জমিতে তাদের ঘর তুলতে দিয়েছিলেন। তাদেরই একজনের দুধেল গরুকে মেরে চলে গেছে...
১৬. একটি মানুষের চেহারা
না দেখলে ভাবতেই পারতেন না অমরনাথ একটি মানুষের চেহারা কয়েক বছরে এত পাল্টে যেতে পারে? প্রতুল বন্দোপাধ্যায় অবশ্যই অসুস্থ। কিন্তু তাঁর গলার স্বরও রুগ্ণ হয়ে গিয়েছে। গাল বসে গিয়েছে, চুলেও সাদা ছাপ পড়েছে। হরদের ঘোষাল দরজা থেকে ফিরে এলেন, না আমার আর এখানে বসে থাকা ঠিক হবে...
১৭. জলপাইগুড়ি শহরে
জলপাইগুড়ি শহরে কেউ কখনও রাস্তা হারায় না। হোস্টেল থেকে কলেজ মাত্র পনের মিনিটের পথ। তবু দীপাকে হোস্টেলে পৌঁছে দেবার দিন অমরনাথ বারংবার সাবধান করে দিয়েছিলেন এ ব্যাপারে। সেদিন দীপার একটুও ভয় ভয় করেনি। অমরনাথ যখন বলেছিলেন, কখনও তো তুই একা থাকিসনি আমাদের ছেড়ে, চিন্তা হচ্ছে...
১৮. পুলিশের লাঠিচার্জ
পুলিশের লাঠিচার্জ নিয়ে জলপাইগুড়ি শহরে বামপন্থী আন্দোলন তীব্র হবে আশংকা করেই কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হল। চা-বাগানে থাকতে আন্দোলনেব। গল্প দীপা পড়ত খবরের কাগজে। জ্ঞান হবার পাব থেকে সে সেখান কোন মিছিল দ্যাখেনি। আন্দোলন মানে শেষপর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে লড়াই, একদল লাঠি নিয়ে তেড়ে...
১৯. রমলা সেনের কাছে
দীপা সত্যি কথা বলল, রমলা সেনের কাছে। অমরনাথ এবার যেন একটু স্বস্তি পেলেন, সেই সকাল থেকে তোর জন্যে বসে আছি। কোথায় যাচ্ছিস হোস্টেলে বলে যাবি তো। বন্ধুর বাড়ি বললে কিছু বোঝা যায়! ওঁর কোন আত্মীয় আছে নাকি জলপাইগুড়িতে! না, আত্মীয় নেই। ও, সেই গেস্ট হাউসে, যেখানে থেকে পরীক্ষা...
২০. জলপাইগুড়ির হোস্টেলের মেয়ে
এখনও জলপাইগুড়ির রাস্তায় কোন হোস্টেলের মেয়ে একা ঘুরে বেড়ায় না। দীপা এমন কাণ্ড করেছে কয়েকবার। সুপারিনটেনডেন্ট ঘরে ডেকে বেশ কড়া কথা শুনিয়েছেন। পরিষ্কার বলেছেন, দেখো, তোমাদের দায়িত্ব আমার ওপর দেওয়া হয়েছে। কিছু ঘটলে কৈফিয়ত আমাকেই দিতে হবে। তোমাদের বয়সের মেয়েকে এক রাস্তায়...
২১. দুশ্চিন্তার ছাপ
দূর থেকে অমরনাথকে দেখে দীপার মনে হয়েছিল কিছু একটা হয়েছে। দুশ্চিন্তার ছাপ মানুষটিব মুখে বেশ স্পষ্ট গেস্টরুমের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে একটা ছোট্ট রাগ যা এর আগে সে কখনও দেখেনি।
দীপা দাঁড়াতেই অমরনাথ মেয়েকে দেখলেন। তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ এবং বিরক্ত থাকায় দৃষ্টিটা বেশীক্ষণ স্থির রাখলেন না। মুখ ঘুরিয়ে বললেন, তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে এসেছি। এই ঘরে বসা যাবে?
দীপা মাথা নাড়ল। গেস্টরুমে একমাত্র পিতামাতা এলেই অনুমতি না নিয়ে বসা যায়। সে আগে এগিয়ে গিয়ে বলল, এসো।
অমরনাথ চেয়ারে বসলে দীপা জিজ্ঞাসা করল, মা ঠাকুমা কেমন আছে?
তাদের খবরে তোমার কোন প্রয়োজন আছে?
মানে? চমকে তাকাল দীপা। বাবাকে এমন গলায় কথা বলতে সে কখনও শোনেনি। অমরনাথ তখন ব্যাগটি কোলেব ওপর রেখে পকেট হাওড়াচ্ছেন। তিন চারটি কাগজপত্রের মধ্যে একটি বিশেষ কাগজ বের করে বললেন, এটা পড়ে দেখ।
সামান্য তফাতে দীপা দাঁড়িয়েছিল। কিছুক্ষণ থেকেই ধন্দ লাগছিল খুব। অমরনাথের এগিয়ে ধরা কাগজটা যে একটা চিঠি তা বুঝতে সময় লাগল। ভাঁজ খুলতেই পাকা হাতের লেখায় সম্বোধন চোখে পড়ল, মাননীয় অমরনাথ মুখোপাধ্যায় সমীপেষু, এই চিঠি প্ৰায় বাধ্য হইয়াই আপনাকে লিখিতেছি। আপনার কন্যা দীপাবলী জলপাইগুড়ির হোস্টেলে থাকিয়া কলেজে ভর্তি হইয়াছে। আপনি অনেক দূর স্থানে বাস করেন বলিয়া শহরের কোন সংবাদ নিয়মিত রাখিতে পারেন না বলিয়া বিশ্বাস করি।
আপনার অবগতির জন্য জানাইতেছি যে দীপাবলীর ব্যবহার ও আচরণ সনাতন বঙ্গরমণীর বিপরীত। তাহাকে উচ্ছঙ্খল আখ্যা দেওয়াই সঙ্গত। জলপাইগুড়ি শহর বিলাত আমেরিকা নহে। এখানে ছাত্রীরা অধ্যয়নের বাইরে অন্য জীবনযাপন করে না। কিন্তু দীপাবলী ছাত্রীদের সঙ্গ ত্যাগ করিয়া ছাত্রদের সঙ্গে দিনরাত মশগুল থাকে। কলেজে তো বটেই, শহরের রাস্তাতেও তাঁহাদের ঢলঢলির দৃশ্য নিযমিত দেখিতে পাওয়া যায়। এই বেলোপনা শহরের যুবকদের কোন পথে নিয়া যাইতেছে তাহা নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারিতেছেন। আশঙ্কা হইতেছে এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া সুকুমারীমতি অন্যান্য ছাত্রীরা যদি একই আচরণ করে তাহলে সমস্ত শহরের জীবনযাত্রা ও ঐতিহ্য গোল্লায় যাইবে।
আমার একমাত্র পুত্র ওই কলেজে দীপাবলীর সহপাঠী। আপনার কন্যার ওই আচরণ দেখিয়া সে নষ্ট হইতে বসিয়াছে। এই অবস্থায় হয় আপনি কন্যাকে সংযত করুন নয় তাহাকে চা-বাগানে ফিরাইয়া নিয়া যান। ইতি, আপনার এক শুভাকাঙক্ষী। চিঠিটা পড়া হয়ে গেলে দীপা মুখ তুলল। তার মুখে নিশ্চয়ই কোন কৌতুকেবা চিহ্ন স্পষ্ট ছিল তাই অমরনাথ সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, তুমি কি চিঠিটা পড়লে? তোমার মুখ দেখে আমি বুঝতে পারছি না।
হ্যাঁ, পড়লাম। দীপা কাগজটা ভাঁজ করে অমরনাথের হাতে ফিরিয়ে দিল।
এটা পড়ার পরেও তুমি হাসছ?
বাবা, যারা চিঠি লেখে। অথচ নাম সই করতেপারে না। তাদের কোন রকম গুরুত্ব দেওয়াটা বোকামি। বেনামী চিঠির লেখকরা মেরুদণ্ডহীন।
তোমার কাছে আমি উপদেশ শুনতে আসিনি। মনে কবো না কলেজে পড়ছ, বলে তোমার চারটে হাত গজিয়েছে। এ চিঠিতে যা লেখা রয়েছে তা সত্যি?
আমি কি বলব?
কি বলার মানে? আমি জানতে চাইছি। সত্যি কি না?
দীপা খুব নীচু গলায় বলল, তোমার কি ধারণা?
আমার ধারণার কথা হচ্ছে না। আমি থাকি চা-বাগানে। তুমি এখানে কি কলছ তা তোমার জানার কথা। তোমার মুখেই সেটা শুনতে এসেছি।
তুমি কি জানতে চাইছ?
কতবার এককথা বলব?
তার আগে তুমি বল বেলেল্লাপনা মানে কি?
নির্লজ্জ আচরণ।
আমি সেটা কোনদিন করিনি।
তাহলে এই লোকটার কি দায় পড়েছিল। পয়সা খরচ করে আমাকে লিখতে?
কোন লোকটা?
ও, বেনামী চিঠি বলে কোন গুরুত্ব থাকবে না। ঘটনা মিথ্যে হয়ে যাবে?
না। নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছিল। যে লিখেছে সে সেটাকে বিকৃত করেছে?
কি ঘটেছিল?
আমার ক্লাসের কিছু ছেলে মেয়েদের বিরক্ত করত। অনেক বছর ধরে চলে আসছিল ব্যাপারটা। মেয়েরা সেটা মুখ বুজে মেনে নিত। আমি মানিনি। কিন্তু ওদের সঙ্গে ঝগড়া না করে আলাপ করেছিলাম। আসলে এখানকার ছেলেদের সঙ্গে কোন মেয়ে প্রকাশ্যে কথা বলে না বলেই ছেলে বা ওরকম আচরণ করে। আমার মনে হয়েছিল, আমরা একসঙ্গে পড়ি, একই বয়েস, তখন সামান্য কথা বলতে দোষ কি! আর সেটা করতেই ওদের ব্যবহার পাল্টে গেল। এখন যার সঙ্গে ক্লাসের ভেতরে কথা বলি তার সঙ্গে রাস্তায় দেখা হলে মুখ ঘুরিয়ে যাওয়া যায়? কলেজে যাওয়া আসার সময় কারো কারো সঙ্গে কথা বলেছি। আমার মনে হয়েছে ওরা যে কোন মেয়ের চেয়ে নতুন বিষয়ে কথা বলতে পারে। কিন্তু হোস্টেলের বড়দি বললেন আমার এই আচরণ নাকি অনেক মেয়ের বাবা মেনে নিতে পারছেন না। ওদের সঙ্গে কথা বললে আমাকে হোস্টেল ছাড়তে হবে। হোস্টেল ছাড়লে আমি পড়াশুনার সুযোগ পাব না। বাধ্য হয়েই আমি ছেলেদের এ সব বলেছি। ওরা আর আমার সঙ্গে কথা বলে না। আমার বয়সের ছেলেরা অনেক বেশী বুঝতে পারে। কথাগুলো বলতে বলতে দীপার। গলার স্বর ভাবি হয়ে এল, চোখ ভিজে উঠল।
তোমাকে কি এখানে প্ৰগতি করতে পাঠানো হয়েছিল?
মানে?
তুমি এসেছিলে পড়াশুনা করতে। তার বাইরে অন্য কোন ব্যাপারে মন দেওয়ার কোন কথা ছিল না। আজ নিশ্চয়ই সারা শহরে এ ব্যাপার নিয়ে কথা হচ্ছে। যে দেশে থাকবে সেই দেশের মানযারা যে আচরণ করে তাই তোমাকে করতে হবে। চা-বাগানে বিশু বাপী খোকনের সঙ্গে মিশতে, আমরা ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি, তাও বড় হবার পর তোমার ঠাকুমা মা সেটা অপছন্দ করেছেন। আগুন আর কাঠ পাশাপাশি যদি কোন আড়াল না রেখে থাকে, তাহলে অগ্নিকাণ্ড ক্লাবেই; নিষেধ এই কারণে। ছি ছি ছি, এ তুমি কি করলে?
আমি কিন্তু কিছুই করিনি।
তোমাকে আজকাল আমি বুঝতে পারি না। হয় তুমি বোকা নয় মিথ্যেবাদী।
আমি তোমাকে কি মিথো বলেছি?
অমরনাথ জবাব দিলেন না। কয়েক মুহূর্ত মাটির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন। তারপরঅনািরকম গলায় বললেন, এ চিঠি পাওয়ার পর থেকে আমার চোখে ঘুম নেই। তোমার মা বা ঠাকুমাকেও চিঠিটাব কথা বলতে পারিনি। কারণ আমি চাই না। ওরা এই আঘাত পাক। এখন একমাত্র উপায় তোমাকে চা-বাগানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া।
না। চিৎকার করে উঠল দীপা।
পয়সা খরচ করে কেউ দুর্নাম কিনতে চায় না।
আমি এমন কিছু করিনি। যাতে তোমার দুর্নাম হয়।
অমরনাথ হাতে ধরে থাকা চিঠিটা নাড়ালেন, এটা পড়েও বলছ?
দীপা দিশাহারা হয়ে গেল। সাঁতা, অমরনাথকে খুব কাহিল দেখাচ্ছে এখন। যদি জলপাইগুড়ি থেকে চলে যেতে হয় তাহলে ভবিষ্যতে নিজের পায়ে দাঁড়ানো যাবে না কখনও। সে কথা খুঁজে না পেয়ে বলল, বাবা, তুমি আমাকে বিশ্বাস করছ না?
অমরনাথের চোযাল শক্ত হল। তিনি কোন জবাব দিলেন না।
বাবা, আমি তো বড়দিকে কথাই দিয়েছি। এই কলেজে পড়ার সময় কোন ছেলের সঙ্গে আর কথা বলব না। তুমি আমাকে আর একবার সুযোগ দাও।
অমরনাথ এবার মুখ খুললেন, ব্যাপারটা শুধু আমার ওপর নির্ভর করছে না। যে ভদ্রলোক দয়া করে তোমার পড়ার খরচ দিচ্ছেন খবরটা নিশ্চয়ই তাঁর কানেও উঠেছে। তিনি যদি সেটা বন্ধ করে দেন তাহলে——।
তিনি তো তোমাকে কিছু বলেননি এখনও।
তা বলেননি–।
যদি কিছু বলেন তাহলে আমি তাঁর কাছে যাব। সব বুঝিয়ে বলব।
চকিতে সোজা হয়ে বসলেন অমরনাথ, না না। ওখানে তুমি যাবে না। মিস্টার রায় সেটা কখনই পছন্দ করবেন না।
অমরনাথের এই প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করার মত মানসিক অবস্থা দীপার ছিল না। তার দু গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। অমরনাথ চোখ তুলে মেয়েকে দেখলেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, কান্নার কোন দরকার নেই।
চকিতেই বাবার সেই কথাগুলো মনে পড়ল। বাবা বলতেন, রক্তের চেয়ে চোখের জল অনেক বেশী মূল্যবান। কিন্তু আজ সেই কথাগুলো বললেন না।
দীপা আচিলে মুখ মুছল। তারপর কাঁপা গলায় বলল, তুমি যদি চাও তাহলে একবার বড়দির সঙ্গে কথা বলতে পার।
অমরনাথ মাথা নাড়লেন, আমার কারো সঙ্গে কথা বলার দরকার নেই।
কিন্তু তুমি আমাকে বিশ্বাস করছ না বাবা?
ঠিক আছে। তুমি যা বলছি তা যেন সত্যি হয়, সেইটে দেখো। ব্যাঙ্ক থেকে তোমার নামে টাকা এসেছে? অমরনাথ উঠে দাঁড়ালেন।
হ্যাঁ। অত টাকা আমার দরকার নেই।
যা দরকার তা রেখে বাকিটা তোমার মাকে, দিয়ে দাও।
দীপা ইতস্তত করল একটু। অমরনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু বলবে?
না। মানে, ওই টাকা তো মিস্টার বায়ের অফিস থেকে আমার পড়াবা জন্যে আসছে। ওঁকে বললে হয় না। কম টাকা পাঠাতে?
উনি মনে করেন অতটাই তোমার দরকার। তোমার প্রয়োজন না থাকলে তুমি যা ইচ্ছে তাই করতে পার। এ বিষয়ে, কথা বলতে গেলে উনি নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত হবেন। বড়লোকের খেয়াল বলে কথা।
তাহলে দাঁড়াও, আমি এনে দিচ্ছি। দীপা দ্রুত বেরিয়ে গেল। এখন তাকে অনেক সহজ দেখাচ্ছে। অমরনাথ চিঠিটাকে পকেটে রাখলেন। হাতের লেখা দেখে বোঝার উপায় নেই কে লিখেছে। তবে খামেব ওপর জলপাইগুড়ি পোস্ট অফিসেব ছাপ ছিল। সেইটেই স্বাভাবিক। কিন্তু ওটা পাওয়ার পর থেকেই মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল তাঁর। এখন মেয়ের পরিবর্তন দেখে একটু ভাল লাগছে। দীপা ফিরে এল প্ৰায় দৌড়েই। তার হাতে বেশ কয়েকটা দশ টাকার নোট। অমরনাথ মেয়েকে বসতে বলে কাগজ কলম বের করলেন। দীপার যা যা প্রয়োজন তা আর একবার হিসেব করা হল। দেখা গেল একশ টাকা হলেই পুরো খরচ মিটে যায়। দীপা বাকি টাকাগুলো অমরনাথের হাতে দিতে তিনি সেটা পকেটে রেখে দিলেন। এবং এই সময় দীপার আনার কথা মনে পড়ল। সে বলল, জানো, এর মধ্যে একদিন আমি খুব চমকে গিয়েছিলাম?
অমরনাথ মুখে কিছু না বলে গম্ভীর মুখে অপেক্ষা করলেন। আসলে সেই মুহুর্তে তিনি এক লজাবোধে আক্রান্ত ছিলেন.। মেয়েকে টাকা দেওয়ার বদলে মেয়ের টাকা তিনি নিচ্ছেন, এইটে বড় খোঁচা দিচ্ছিল। চেক নেওয়া, ব্যাঙ্কে জমা দেওয়ার মধ্যে প্ৰত্যক্ষ প্ৰাপ্তি ছিল না।
দীপা বলল, হঠাৎ আনা নামের সেই কাজের মহিলা এই হোস্টেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল।
আনা? অমরনাথ চমকে উঠলেন।
যে আমাকে ওই বাড়ি থেকে পালাতে সাহায্য করেছিল। কি বিরাট চেহারা হয়েছে, মোটাসোটা, কাজের লোক বলে আর চেনাই যায় না।
আনা। এখানে এসেছিল? বিড়বিড় করলেন অমরনাথ।
হ্যাঁ। কিন্তু আমি এখানে আছি তা ও জানল কি করে?
জেনেছে নিশ্চয়ই।
ও এসেছিল তোমার খবর নিতে। তোমার সঙ্গে ওর কি দরকার?
অমরনাথ নার্ভাস বোধ করলেন। আনাব ওপর অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে উঠলেন তিনি। তার এখানে আসার কি দরকার ছিল! দীপা দেখল। অমরনাথ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছেন। সে দ্বিতীয়বার প্রশ্নটা করল। অমরনাথ সজাগ হলেন, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। ব্যানার্জী মশাই-এর শরীর খারাপ হল কি না কে জানে! আর তুমি যে এখানে আছ তা হরদেব দেখে গিয়েছেন। খবরটা তিনিই দিতে পারেন। তোমার এখানে না এসে আমাকে চিঠি দিতে পারত!
কেন? দীপার মুখে বক্ত জমল, তোমার সঙ্গে কিসের সম্পর্ক? কে অসুস্থ কি না তা তোমাকে জানাতে হবে কেন? ও বাড়ির সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই তা তুমি জান না? আমি ভাবতেই পারি না। এসব। নেহাত ওই কাজের মেয়েটা আমার উপকার করেছিল সেদিন তাই আমি খারাপ ব্যবহার করতে পারিনি।
দ্যাখ মা, সবসময় স্মৃতি আঁকড়ে বসে থাকতে নেই।
তুমি কি বলতে চাইছ?
অতীতে ওঁরা অন্যায় করেছিলেন, আমরাও যোগাযোগ রাখিনি। সম্পর্ক যা ছিল তা শুধু বলার জন্যেই। তোকে পরীক্ষা দিতে হয়েছে কলেজে ভর্তি হতে হয়েছে ওদের উপাধি নিয়ে। কিন্তু দিন আর নদীর জল সবসময় সমান বহে যায় না। খবর তো আমারও কানে আসে। ব্যানার্জী মশাই পক্ষাঘাতে পঙ্গু এখন, ওঁর স্ত্রী উন্মাদাশ্রমে। সংসার ছাড়খার হয়ে গিয়েছে। এখন বিষ তো দূরের কথা, ছোবলও নেই। অমরনাথ কথাগুলো বলতে বলতে মেয়ের দিকে তাকাচ্ছিলেন। কিন্তু মেয়ের মুখে কোন পরিবর্তন দেখতে পেলেন না।
দীপা বলল, যেমন কর্ম করেছে তেমন ফল পাচ্ছে। কিন্তু তাতে আমাদের কি? তুমি ওদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখবে না বলে দিলাম। আর আমার কাছে যদি কেউ আসে তাহলে আমি মুখের ওপর কথাটা বলে দেব।
দীপা, তুই কি এখনও ব্যাপারটা ভুলতে পারছিস না?
তুমি কি বলছি বাবা? আমি কোনদিন ভুলতে পারব! তোমরা আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছিলে, আমার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিতে চেয়েছিলে–
কি বলছিস তুই? আমি জেনেশুনে তোর ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে চেয়েছিলাম? এমন কথা তুই উচ্চারণ করতে পারলি? অমরনাথের গলার স্বর পাল্টে গেল।
দীপা মাথা নাড়ল, আমার কি ক্ষতি হয়েছে তুমি জানো না? বন্ধুবান্ধবদের পর্যন্ত ব্যাপারটা বলতে পারি না। সবাই জানে আমি কুমারী। ব্যাপারটা ভাবলেই বমি পায় আমার। আর তুমি এখন ওদের হয়ে নরম নরম কথা বলতে এসেছী। তোমার ওপর আমার রাগ হওয়া অন্যায়? তুমি বল?
অমরনাথ হাসার চেষ্টা করলেন, দ্যাখ। দীপা, রাগ করে দূরে থেকে নিজের কোন লাভ হয় না। আমি প্ৰতিশোধ নিতে চাই। তোর ওপর যে অত্যাচার হয়েছে তার দাম দিয়ে যেতে হবে প্রতুল ব্যানার্জীকে। আমি সেই চেষ্টাই করছি।
দীপা অবাক হয়ে তাকল, দাম? ওই অন্যায়ের কি দাম হতে পারে?
দেখি! অমরনাথ মাথা নিচু করলেন, অনেক চিন্তা করার আছে। ঠিক আছে, ভালভাবে থাকিস। আজ আমি চলি।
অমরনাথ গেস্টরুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির ধাপে পা রাখতেই দীপা পেছন থেকে ডেকে উঠল, বাবা! অমরনাথ মুখ ফেরালেন না।
দীপা এগিয়ে এল, আমার কোন দাম দরকার নেই।
অমরনাথ মাথা নাড়লেন, শুনলাম।
তুমি কি এ কথাটা জানতে না?
জানি। কিন্তু জীবন তো কোন হিসেব মেনে চলে না। আজ যে অত্যন্ত ঘূণ্য শত্ৰু কাল যদি সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে তোর কাছে এক গ্লাস জল চায় তাহলে কি তুই মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবি। মানুষ হলে পারবি না। এটাই জীবনের নিয়ম। তোর কিছু চাই না, কিন্তু আমিও তো একইভাবে প্রতারিত হয়েছি, সে জ্বালা মেটাবার সুযোগ পেলে ছাড়ব কেন?
তুমি কি ওদের বাড়িতে যােচ্ছ? দীপা সরাসরি প্রশ্ন করল।
অমরনাথ একটু ইতস্তত করলেন, হ্যাঁ। আনা কেন এসেছিল তা জানা দরকার। হয়তো–! তাছাড়া তাকে নিষেধ করতে হবে, এখানে যেন আর না আসে।
অমরনাথ আর দাঁড়ালেন না। হন হন করে, হোস্টেলের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তাঁর যাওয়ার ধরন দেখে দারোয়ান পর্যন্ত অবাক হয়ে গেল। দীপা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল! তার কেবলই মনে হচ্ছিল অমরনাথ সত্যি কথাটা গোপন করছেন। আজ যে মেজাজ এবং চেহারা নিয়ে তিনি চিঠি পেয়ে ছুটে এসেছিলেন তার সঙ্গে চলে যাওয়ার সময় তার চেহারাদ্য কোন মিল নেই। প্ৰথম দিকে তিনি যেভাবে ক্ৰোধ প্ৰকাশ করেছেন শেষ দিকে যেন পালিয়ে গেলে বাঁচেন, এমন মুনে হচ্ছিল। জ্ঞান হবার পর সে অমরনাথকে ওই ভঙ্গী এবং ভাষায় কথা বলতে শোনেনি। আজ এক সম্পূর্ণ অচেনা অমরনাথ হোস্টেল থেকে পালিয়ে গেলেন। হ্যাঁ, বাবার যাওয়াবা ভঙ্গীটাকে পালানো বলাই ঠিক। বাবার সঙ্গে নিশ্চয়ই ওদের যোগাযোগ আছে। এটুকু ভাবতেই শরীর জ্বলতে লাগল। যোগাযোগ আছে বলেই আনা এসেছিল। প্রতুল ব্যানার্জীর পক্ষাঘাত হয়েছে, তার স্ত্রী উন্মাদ–এতে তার কিছু এসে যায়; না। কিন্তু বাবা কেন ওদের বাড়িতে যাওয়া আসা করছে! দীপার ইচ্ছে হচ্ছিল এখনই চা-বাগানে ছুটে যেতে। অঞ্জলিকে সব কথা খুলে বললে বাবার পরিবর্তনেব কারণটা জানা যাবে। কিন্তু তখনই মনে হল, মা যদি তার কাছে লুকিয়ে যান? দীপা ভেবে পাচ্ছিল না কি করা উচিত!
থানার পাশ দিয়ে করলা নদীর ধার দিয়ে ঝোলনা ব্রিজের কাছে পৌঁছে অমরনাথের চেতনা পরিষ্কার হল। এতক্ষণ তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ছুটে আসছিলেন। মেয়ের হোস্টেলে যাওয়ার জন্যে আনাকে কটুকথা বলবেন। পারলে প্রতুলবাবুকেও কথা শোনাতে ছাড়বেন। না। যে সর্বনাশ তাঁরা এককালে করেছেন তার পুনরাবৃত্তি হতে দেবেন না তিনি।
কিন্তু ঝোলনা ব্রিজের ওপর উঠে মনে হল এরকম রাগের কোন মানে হয় না। সাত দিনের বদলে অনেক দিন হয়ে গেল। ব্যাপারটা নিয়ে তিনি অনেক ভেবেছেন। বীরপাড়া চা-বাগানের গুদামবাবুর ভায়রাভাই উকিল। ভদ্রলোক শালির বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। তাঁর সঙ্গে দেখা করে অমরনাথ সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলেছেন। তিনিও বলেছেন, প্রতুল বন্দোপাধ্যায় যদি উইল করে কাউকে দিয়ে না যান তাহলে সমস্ত সম্পত্তির কনম্বব উত্তবাধিকারিণী দীপা। কিন্তু আনা যেখানে আছে সেখানে উইল হবেই। তিনি না গেলে আনা অন্য কাউকে ধরতে পারে। গোডালিতে ফোস্কা পড়ছে বলে কোন মুর্থ বলে না যে সে জুতো ব্যবহার করবে না। আনার দেওয়া প্রতুলবাবুর তৈরীি উইলের খসড়া থেকে সম্পত্তির যে হিসেব পাওয়া গিয়েছিল তাই উকিল ভদ্রলোককে দিয়ে দিয়েছিলেন অমরনাথ। কথা ছিল তিনি সব কিছু লিখে স্ট্যাম্প পেপারে টাইপ করিয়ে রাখবেন। ভদ্রলোকের বাড়ি এই করলা নদীর ধারে জলপাইগুড়ি গার্লস স্কুলের পাশেই।
অমরনাথ পথ পবিবর্তন করে জিজ্ঞাসাবাদ করে উকিলবাবুর বাড়িতে পৌঁছালেন। ভদ্রলোক তখনও বাইরের ঘরে মক্কেলদের নিয়ে বসে। অমরনাথকে ঢুকতে দেখে মাথা নেড়ে বললেন, বসুন। অমরনাথ কোণাব দিকে একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসলেন। মকেলদের সঙ্গে কথাবার্তা সাবতে আধা ঘণটা সময় লাগল; অমরনাথ দেখলেন একজন মক্কেল যাওয়ার সময়। কৃডিটি টাকা দিয়ে গেল। উকিলবাবু ডাকলেন, আসুন আপনি আপনার তো অনেকদিন আগেই আসার কথা। দেবি হচ্ছে দেখে গতকালই আমার ভায়রাভাইকে একটা চিঠি দিয়েছি। কি ব্যাপার মশাই?
নানারকম ঝামেলায় আটকে পড়েছিলাম।
শুনুন, এ যা সম্পত্তি তার তুলনায় কোন ঝামেলাই ইমপটেন্ট হতে পারে না! আচ্ছা, এই আনা মহিলাটিকে অংশ দিতেই হবে?
অমরনাথ অসহায় ভাবে মাথা নাড়লেন।
বুঝুন, বাড়ির ঝি সেবা করে মাথায় উঠছে। কাটানো যায় না?
কি ভাবে?
কাটাতে চান? তাহলে আমার ওপর ছেড়ে দিন।
অমরনাথ দ্বিধায় পড়লেন। আনাকে প্রতারিত করে পুরো সম্পত্তির দখল নিলে লাভ হয় নিশ্চয়ই কিন্তু মন সায্য দিচ্ছে না। তা ছাড়া সইসাবুদ তো আনাই প্রতুলবাবুকে দিয়ে করাবে। ব্যাপারটা জানতে পারলে সে অনর্থ করে ছাডবে। না, কারণ অভিশাপ থাকলে সম্পত্তি থেকে সুখ পারেন না তিনি। অমরনাথ মাথা নাড়লেন, দাবকার নেই, যেমন বলেছি তেমন করুন।
উকিলবাবু হাসলেন, আপনার যেমন ইচ্ছে। কাগজপত্র সব তৈরী করেই রেখেছি। তিনি উঠে আলমারির দরজা খুলে একটা ফাইল টেনে আনলেন, যত তাড়াতাড়ি পারেন পেন্সিলে টিক দেওয়া জায়গাগুলোয় সই করিয়ে আনুন। বাকি কাজটা আমি করে দেব।
অমরনাথ স্ট্যাম্প পেপারগুলো নিয়ে মন দিয়ে পড়তে লাগলেন। হ্যাঁ, সব ঠিকঠাক আছে। উকিলবাবু টেবিলের উল্টোদিকে বসেছিলেন। পড়া শেষ হলে আচমকা প্রশ্ন করলেন, আপনি হরদেব ঘোষালকে চেনেন? আপনার বেয়াই মশাই-এর বন্ধু!
চমকে উঠলেন অমরনাথ। পরীক্ষণেই মনে পড়ল কোর্ট কাছারিতে ঘোরাঘুরি করা হরদেবের নেশা। একই শহরের লোক সেই সূত্রে পরিচিত হতেই পারে। তিনি মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ।
ভদ্রলোকের কাছে প্রতুলবাবুর কাহিনী শুনলাম। ওই আনা মেয়েটা তো মুঠোয় করে রেখেছে তাকে। খুব সুন্দরী নাকি?
না। তেমন নয়।
তাহলে নিশ্চয়ই স্বাস্থ্য ভাল। হা হা শব্দ করে হাসলেন উকিলবাবু, হরদেব বাবুর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কি রকম?
আলাপ আছে।
উঁহ, মনে হল আরও বেশী কিছু। যাক, আর দেরি করবেন না।
একটু ইতস্তত করে অমরনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি হরদেবকে এই উইলের কথা কিছু বলেছেন?
না মশাই। সেই বুদ্ধি না থাকলে ওকালতি করে খেতে পারতাম না। লোকটা একটা শেয়াল, খ্যাক শেয়াল বললেও কম বলা হয়। আমার মক্কেল আপনি, সে নয়।
অমরনাথ খুশী হলেন, কত দিতে হবে?
আমাকে? দুলে দুলে নিঃশব্দে হাসতে লাগলেন উকিলবাবু, রাজার সম্পত্তি পেতে চলেছেন। এখনই কিছু দেওয়ার দরকার নেই। তবে পাওয়ার আগে আঙুলগুলো আর মুঠো করবেন না, তাহলেই হবে। পারলে আজই সই করিয়ে আনুন।
তবু যদি একটা আন্দাজ দেন।
আরে মশাই, এখন আপনার পকেটে যা আছে তাতে আমার কোন আসক্তি নেই। আমি আমারটা ঠিক সময়মত আপনার কাছে চেয়ে নেব। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে কোর্টে চলে আসবেন। উকিলরা যেখানে বসে সেখানে খোঁজ করলে পেয়ে যাবেন।
ঝোলনা ব্রিজ পেরিয়ে হাকিমপাড়ায় ঢুকলেন অমরনাথ। এত শান্ত এলাকা যে মনেই হয় না শহরে এসেছি। চারপাশে নজর রেখে তিনি এগোচ্ছিলেন। তাঁর ভয় হচ্ছিল পথে হরদেবের সঙ্গে দেখা না হয়ে যায়। কিন্তু প্ৰতুল বন্দোপাধ্যায়ের বাড়ির গেট পর্যন্ত আসতে কোন বিঘ্ন ঘটল না। বাগানের ভেতরে পা দিতেই গন্ধটা নাকে এল। বাঁ দিকে একটা স্বাস্থ্যবান মাঝারি উচ্চতার গাছে পদ্মের মত সুন্দর ফুল ফুটেছে। একটু চিন্তা করে নামটা মনে করতে পারলেন তিনি, গ্ল্যান্ডিফ্লোরা। গন্ধে বুক ভরে যায়। ফুল ফোটে তার সময়মত শুধু মানুষের সময়টায় কোন হিসেব থাকে না।
সদর দরজা যথারীতি বন্ধ। চট করে মনে হয় কেউ বাস করে না। অমরনাথ দরজায় শব্দ করলেন কয়েকবার কিন্তু সাড়া মিলল না। প্রতুলবাবু নিশ্চয়ই মারা যাননি। এই ছোট্ট শহরে প্রতুলবাবুর মত মানুষ মারা গেলে মুখে মুখে খবর ছড়াতো। হঠাৎ অমরনাথের মনে হল উইলটুইল করার আগেই যদি প্রতুলবাবু চলে যান তাহলে আনাকে এক পয়সাও দিতে হবে না। সমস্ত সম্পত্তি আইনমোতাবেক দীপাই পারে। মরে গেল নাকি? পরীক্ষণেই মাথা নাড়লেন তিনি। কিছু বিশ্বাস নেই, কোথেকে একটা উইল বেরিয়ে পড়বে আর চোখে ধুতরো ফুল দেখতে হবে। যত যাই হোক, কোন মানুষেব মৃত্যু কামনা করা ঠিক নয়।
শেষ পর্যন্ত মনে পড়ল!
গলাটা শুনেই চমকে ফিরে তাকালেন অমরনাথ। বাগানের রাস্তান্য দাঁড়িয়ে আছে আনা। কে বলবে বাড়ির বি। শরীর স্বাস্থ্য যেন আরও ঝকমকে। স্নান করেছে বলে আরও টাটকা দেখাচ্ছে। হাতে ফুলের সাজি। ফুল তুলতে বেরিয়েছিল। পেছনের দরজা দিয়ে।
অমরনাথ আমতা আমতা করলেন, সব কিছু তৈরী করতে দেরি হয়ে গেল!
আমি হনুমান নাকি যে সূর্যকে বগলে আটকে রাখব? এই সময়ে তিনি যদি স্বৰ্গে চলে যেতেন তাহলে ওই তৈরী করা কাগজ আমার কোন কাজে লাগত?
অমরনাথ হাসলেন, শেষ ভাল যার সব ভাল। এখন সব তৈরী।
আসুন। এদিক দিয়ে। সদর খোলা নেই। কথাগুলো বলে আনা বাগানের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে লাগল। ওকে অনুসরণ করে প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি অমরনাথ হঠাৎ শিহরিত হলেন। আজকাল অঞ্জলির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক দৈবাৎ হয়। তাঁর বাসনা অঞ্জলির নির্লিপ্তির কাছে চাপা পড়ে যায়। কোথায় যেন পড়েছিলেন, বাঙালি মেয়েদের মন পয়ত্ৰিশের এপাশে চলে এলেই শরীর নিবিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চায়। অথচ আনার বয়স চল্লিশের এদিকে তো নয়ই। কিন্তু হাঁটার ধমকে সমস্ত শরীরে ঢেউ বয়ে যাচ্ছে তার। নিজেকে সংযত করতে প্ৰাণপণে চেষ্টা করছিলেন অমরনাথ। দেশটা বিলেত আমেরিকা নয়। বাঙালি পুরুষ যদি বিবাহিত এবং সন্তানের পিতা হয় তাহলে মনের মধ্যে এক সন্ন্যাসীকে ধরে রাখা অবশ্য কর্তব্য।
পেছনের বারান্দায় পৌঁছে একটা মোড়া এগিয়ে দিল আনা, বসুন। অমরনাথ বসলেন। সাজিটা রেখে দিয়ে এসে আনা বলল, ওমা, আপনার কি শরীর খারাপ মুখচোখ অমন হয়ে গিয়েছে কেন?
অমরনাথ দ্রুত মাথা নাড়লেন, না, না। কিছু হয়নি।
আনার ঠোঁটে হাসি চলকে উঠল, না হলেই ভাল। কই দিন।
অমরনাথ উকিলবাবুর তৈরী উইল এগিয়ে দিলেন। আনা সেটাকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, চা দেব, না সরবত?
অমরনাথ বললেন, কিছু না। আমি খেয়েই এসেছি।
এসেছেন তো চা-বাগান থেকে। এতক্ষণে সব হজম হয়ে গেছে।
না, না, আমার কিছু প্রয়োজন নেই। প্রতুলবাবু কেমন আছেন?
শালগ্ৰামশিলা।
মানে?
নড়াচড়া করতে পারে না যে তাকেই পুজো করতে হয়। আপনার সঙ্গে এব। মধ্যে হরদেবের দেখা হয়েছিল?
না তো।
আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না। আপনার দেরি হচ্ছে কেন? খোঁজ নিতে মেয়ের কলেজে গিয়েছিলাম। সে তো এখন দিব্যি হয়েছে।
হুঁ! তবে আজকালকার মেয়ে তো, এ বাড়ির সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখতে চায় না।
সেটা অ্যাদ্দিন চাইত না। এখন সম্পত্তি পারে, না চাইলে চলে?
ও যে এসব পাচ্ছে তা জানে না।
জানে না মানে?
এ বাড়ির কোনকিছুর সঙ্গে ও যোগাযোগ নেই বলে জানে।
এই যে উনি অতগুলো টাকা দিলেন পড়ার খরচ চালাতে?
অমরনাথ মুখ তুলে তাকালেন। আনার মুখে বিস্ময়। এই মহিলার কাছে প্রতুলবাবু কোন কিছুই গোপন রাখতে শৈষ পর্যন্ত পারেন না। তিনি নিচু স্বরে বললেন, সেটা ব্যাঙ্কে আছে। ব্যাঙ্কই পাঠাচ্ছে। দীপা জানে না!
কদিন ধামাচাপা দিয়ে চালাবেন?
দেখি। অমরনাথ উঠলেন, প্ৰতুলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে পারি?
দাঁড়ান। উনি এখন উদোম হয়ে পড়ে আছেন। চাদর টেনে দিই তারপর যাবেন। আনা ঘরে ঢুকে গেল। তাজব হয়ে গেলেন অমরনাথ। অসুস্থ একটি মানুষ কেন বিবস্ত্ৰ হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকবে? পেচ্ছপ বাহ্যি করাচ্ছিল নাকি? তা তো নয়, আনা তো বাগানে ফুল তুলছিল! ব্যাঙ্কের ব্যাপারটা না বলাই উচিত ছিল।
মিনিট খানেক বাদে প্রতুলবাবুর খাটের পাশে বসেছিলেন অমরনাথ।
চিনতে পারছেন?
না পারার কোন কারণ নেই। প্রতুলবাবুর গলার স্বর মিনমিনে কিন্তু স্পষ্ট। শরীর শুকিয়ে প্রায় দড়ির মত হয়ে গিয়েছে। মুখ এবং বাইরে বেরিয়ে থাকা দুটো হাত দেখে সেটা বোঝা যায়। বাকি শরীর সাদা চাদরে ঢাকা। অমরনাথ অনুমান করলেন সেটি আনা এখনই ঢাকা দিয়েছে। আজ প্রতুলবাবু ঘাড় ঘোরাতে পারছেন না বলে মনে হল। তার মুখ ছাদের দিকে স্থির। চোখ ঘুরছে।
মেয়ে কেমন আছে? সেই অবস্থায় প্রশ্ন করলেন প্রতুলবাবু।
ভাল। কলেজে পড়ছে।
জলপাইগুড়িতেই তো আছে, দেখতে বড় সাধ হয়। প্রতুলবাবুর মুখ থেকে কথাগুলো বেরুতেই আনা বলল, এখন আর সাধ হলে কি হবে।
কি নাম যেন রাখা হয়েছিল? আশা, আশালতা। সেই নাম আর নেয়নি, না?
আনাই জবাব দিল, না।
প্রতুলবাবু বললেন, আমি খুব শিগগির যাচ্ছি না। সে কি আসবে?
দেখি। অমরনাথ বলতে পারলেন।
এবার আনা বুকে তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে কিছু বলল। প্রতুলবাবু চোখ ঘোরালেন, আমাকে আপনারা ক্ষমা করেছেন?
অতীতের ওইসব ব্যাপার। ভুলে যাওয়াই ভাল।
প্রতুলবাবুর মুখে হাসি ফুটল, একটা কথা রাখবেন?
বলুন।
আমি চলে গেলে আপনি আনুকে একটু দেখবেন।
অমরনাথ মুখ তুলতেই আনার ঠোঁটে হাসি খেলে গেল। প্রতুলবাবু হাত তুলতে চেষ্টা করছিলেন। সাদা চাদরটস সরে যাচ্ছিল। আনা প্ৰায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠিক করে দিল সেটা। প্রতুলবাবু বললেন, আর ঢেকে কি হবে। এসেছি যেভাবে যাব সেইভাবে। হাত নেতিয়ে পড়ল শরীরের পাশে।
আনা ইশারা করল বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে। অমরনাথ বললেন, চলি। প্রতুলবাবু সাড়া দিলেন না। চোখের পাতাদুটো বন্ধ হল মাত্র।
বাইরের ঘরে পৌঁছে অমরনাথ ছটফট করতে লাগলেন। উইলটা সই কারাবার কোন চেষ্টাই আনা করল না। লোকটাকে পেছন থেকে ধরে বসিয়ে দিলে নিশ্চয়ই সই করতে পারবে। এখন সই হয়ে গেলে তিনি কোর্টে গিয়ে উকিলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে পারতেন। উইল আইনসঙ্গত করতে কত খরচ পড়বে তিনি জানেন না। আজ না হলে তাঁকে আর একদিন আসতে হবে। এইরকম খুচরো ছুটি পাওয়াও তো মুশকিল।
পায়ের শব্দে মুখ ফেরালেন তিনি। আনা বলল, দাঁড়িয়ে কেন? বসুন।
না, না। যেতে হবে। অমরনাথ ব্যস্ততা দেখালেন।
আনা হাসল, উনি চলে গেলে আমার দায়িত্ব নিতে বললেন আপনাকে, কই, আপনি তো কোন জবাব দিলেন না?
কি বলব? মুখ ঘোরালেন অমরনাথ।
হরদেব ঘোষাল হলে কিন্তু বিশ্বরূপ দেখানোর মত হ্যাঁ করত।
অমরনাথ অস্বস্তিতে পড়লেন। হরদেব নাকি একসময় আনার শরীরের দিকে নজর দিয়েছিল। তাঁকে আর হরদেবকে আনা একই চরিত্রের মনে করছে না কি! আজ হাঁটার ভঙ্গী দেখে কয়েক সেকেণ্ড চঞ্চলত এসেছিল, সেটা কয়েক সেকেণ্ডই। হঠাৎ আনা হাত ঘুরিয়ে বলল, না, বাবা, আমার দায়িত্ব কাউকে নিতে হবে না। অ্যাদ্দিন দেখলাম যখন তখন চিতায় ওঠার আগে ঠিকই টিকে থাকতে পারব।
অমরনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, উইলটা সই করিয়ে নিলে আজই কোর্টে যাওয়া যেত।
আন হাসল, আমি তো ইংরেজি পড়তে জানি না। যাচাই করে নিই। আপনি ঠিকঠাক লিখিয়েছেন কি না। আমার ভাগটা ঠিকমত লেখা আছে কি না। পুরুষমানুষকে আমি বিশ্বাস করি না।
দূর থেকে অমরনাথকে দেখে দীপার মনে হয়েছিল কিছু একটা হয়েছে। দুশ্চিন্তার ছাপ মানুষটিব মুখে বেশ স্পষ্ট গেস্টরুমের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে একটা ছোট্ট রাগ যা এর আগে সে কখনও দেখেনি।
দীপা দাঁড়াতেই অমরনাথ মেয়েকে দেখলেন। তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ এবং বিরক্ত থাকায় দৃষ্টিটা বেশীক্ষণ স্থির রাখলেন না। মুখ ঘুরিয়ে বললেন, তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে এসেছি। এই ঘরে বসা যাবে?
দীপা মাথা নাড়ল। গেস্টরুমে একমাত্র পিতামাতা এলেই অনুমতি না নিয়ে বসা যায়। সে আগে এগিয়ে গিয়ে বলল, এসো।
অমরনাথ চেয়ারে বসলে দীপা জিজ্ঞাসা করল, মা ঠাকুমা কেমন আছে?
তাদের খবরে তোমার কোন প্রয়োজন আছে?
মানে? চমকে তাকাল দীপা। বাবাকে এমন গলায় কথা বলতে সে কখনও শোনেনি। অমরনাথ তখন ব্যাগটি কোলেব ওপর রেখে পকেট হাওড়াচ্ছেন। তিন চারটি কাগজপত্রের মধ্যে একটি বিশেষ কাগজ বের করে বললেন, এটা পড়ে দেখ।
সামান্য তফাতে দীপা দাঁড়িয়েছিল। কিছুক্ষণ থেকেই ধন্দ লাগছিল খুব। অমরনাথের এগিয়ে ধরা কাগজটা যে একটা চিঠি তা বুঝতে সময় লাগল। ভাঁজ খুলতেই পাকা হাতের লেখায় সম্বোধন চোখে পড়ল, মাননীয় অমরনাথ মুখোপাধ্যায় সমীপেষু, এই চিঠি প্ৰায় বাধ্য হইয়াই আপনাকে লিখিতেছি। আপনার কন্যা দীপাবলী জলপাইগুড়ির হোস্টেলে থাকিয়া কলেজে ভর্তি হইয়াছে। আপনি অনেক দূর স্থানে বাস করেন বলিয়া শহরের কোন সংবাদ নিয়মিত রাখিতে পারেন না বলিয়া বিশ্বাস করি।
আপনার অবগতির জন্য জানাইতেছি যে দীপাবলীর ব্যবহার ও আচরণ সনাতন বঙ্গরমণীর বিপরীত। তাহাকে উচ্ছঙ্খল আখ্যা দেওয়াই সঙ্গত। জলপাইগুড়ি শহর বিলাত আমেরিকা নহে। এখানে ছাত্রীরা অধ্যয়নের বাইরে অন্য জীবনযাপন করে না। কিন্তু দীপাবলী ছাত্রীদের সঙ্গ ত্যাগ করিয়া ছাত্রদের সঙ্গে দিনরাত মশগুল থাকে। কলেজে তো বটেই, শহরের রাস্তাতেও তাঁহাদের ঢলঢলির দৃশ্য নিযমিত দেখিতে পাওয়া যায়। এই বেলোপনা শহরের যুবকদের কোন পথে নিয়া যাইতেছে তাহা নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারিতেছেন। আশঙ্কা হইতেছে এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া সুকুমারীমতি অন্যান্য ছাত্রীরা যদি একই আচরণ করে তাহলে সমস্ত শহরের জীবনযাত্রা ও ঐতিহ্য গোল্লায় যাইবে।
আমার একমাত্র পুত্র ওই কলেজে দীপাবলীর সহপাঠী। আপনার কন্যার ওই আচরণ দেখিয়া সে নষ্ট হইতে বসিয়াছে। এই অবস্থায় হয় আপনি কন্যাকে সংযত করুন নয় তাহাকে চা-বাগানে ফিরাইয়া নিয়া যান। ইতি, আপনার এক শুভাকাঙক্ষী। চিঠিটা পড়া হয়ে গেলে দীপা মুখ তুলল। তার মুখে নিশ্চয়ই কোন কৌতুকেবা চিহ্ন স্পষ্ট ছিল তাই অমরনাথ সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, তুমি কি চিঠিটা পড়লে? তোমার মুখ দেখে আমি বুঝতে পারছি না।
হ্যাঁ, পড়লাম। দীপা কাগজটা ভাঁজ করে অমরনাথের হাতে ফিরিয়ে দিল।
এটা পড়ার পরেও তুমি হাসছ?
বাবা, যারা চিঠি লেখে। অথচ নাম সই করতেপারে না। তাদের কোন রকম গুরুত্ব দেওয়াটা বোকামি। বেনামী চিঠির লেখকরা মেরুদণ্ডহীন।
তোমার কাছে আমি উপদেশ শুনতে আসিনি। মনে কবো না কলেজে পড়ছ, বলে তোমার চারটে হাত গজিয়েছে। এ চিঠিতে যা লেখা রয়েছে তা সত্যি?
আমি কি বলব?
কি বলার মানে? আমি জানতে চাইছি। সত্যি কি না?
দীপা খুব নীচু গলায় বলল, তোমার কি ধারণা?
আমার ধারণার কথা হচ্ছে না। আমি থাকি চা-বাগানে। তুমি এখানে কি কলছ তা তোমার জানার কথা। তোমার মুখেই সেটা শুনতে এসেছি।
তুমি কি জানতে চাইছ?
কতবার এককথা বলব?
তার আগে তুমি বল বেলেল্লাপনা মানে কি?
নির্লজ্জ আচরণ।
আমি সেটা কোনদিন করিনি।
তাহলে এই লোকটার কি দায় পড়েছিল। পয়সা খরচ করে আমাকে লিখতে?
কোন লোকটা?
ও, বেনামী চিঠি বলে কোন গুরুত্ব থাকবে না। ঘটনা মিথ্যে হয়ে যাবে?
না। নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছিল। যে লিখেছে সে সেটাকে বিকৃত করেছে?
কি ঘটেছিল?
আমার ক্লাসের কিছু ছেলে মেয়েদের বিরক্ত করত। অনেক বছর ধরে চলে আসছিল ব্যাপারটা। মেয়েরা সেটা মুখ বুজে মেনে নিত। আমি মানিনি। কিন্তু ওদের সঙ্গে ঝগড়া না করে আলাপ করেছিলাম। আসলে এখানকার ছেলেদের সঙ্গে কোন মেয়ে প্রকাশ্যে কথা বলে না বলেই ছেলে বা ওরকম আচরণ করে। আমার মনে হয়েছিল, আমরা একসঙ্গে পড়ি, একই বয়েস, তখন সামান্য কথা বলতে দোষ কি! আর সেটা করতেই ওদের ব্যবহার পাল্টে গেল। এখন যার সঙ্গে ক্লাসের ভেতরে কথা বলি তার সঙ্গে রাস্তায় দেখা হলে মুখ ঘুরিয়ে যাওয়া যায়? কলেজে যাওয়া আসার সময় কারো কারো সঙ্গে কথা বলেছি। আমার মনে হয়েছে ওরা যে কোন মেয়ের চেয়ে নতুন বিষয়ে কথা বলতে পারে। কিন্তু হোস্টেলের বড়দি বললেন আমার এই আচরণ নাকি অনেক মেয়ের বাবা মেনে নিতে পারছেন না। ওদের সঙ্গে কথা বললে আমাকে হোস্টেল ছাড়তে হবে। হোস্টেল ছাড়লে আমি পড়াশুনার সুযোগ পাব না। বাধ্য হয়েই আমি ছেলেদের এ সব বলেছি। ওরা আর আমার সঙ্গে কথা বলে না। আমার বয়সের ছেলেরা অনেক বেশী বুঝতে পারে। কথাগুলো বলতে বলতে দীপার। গলার স্বর ভাবি হয়ে এল, চোখ ভিজে উঠল।
তোমাকে কি এখানে প্ৰগতি করতে পাঠানো হয়েছিল?
মানে?
তুমি এসেছিলে পড়াশুনা করতে। তার বাইরে অন্য কোন ব্যাপারে মন দেওয়ার কোন কথা ছিল না। আজ নিশ্চয়ই সারা শহরে এ ব্যাপার নিয়ে কথা হচ্ছে। যে দেশে থাকবে সেই দেশের মানযারা যে আচরণ করে তাই তোমাকে করতে হবে। চা-বাগানে বিশু বাপী খোকনের সঙ্গে মিশতে, আমরা ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি, তাও বড় হবার পর তোমার ঠাকুমা মা সেটা অপছন্দ করেছেন। আগুন আর কাঠ পাশাপাশি যদি কোন আড়াল না রেখে থাকে, তাহলে অগ্নিকাণ্ড ক্লাবেই; নিষেধ এই কারণে। ছি ছি ছি, এ তুমি কি করলে?
আমি কিন্তু কিছুই করিনি।
তোমাকে আজকাল আমি বুঝতে পারি না। হয় তুমি বোকা নয় মিথ্যেবাদী।
আমি তোমাকে কি মিথো বলেছি?
অমরনাথ জবাব দিলেন না। কয়েক মুহূর্ত মাটির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন। তারপরঅনািরকম গলায় বললেন, এ চিঠি পাওয়ার পর থেকে আমার চোখে ঘুম নেই। তোমার মা বা ঠাকুমাকেও চিঠিটাব কথা বলতে পারিনি। কারণ আমি চাই না। ওরা এই আঘাত পাক। এখন একমাত্র উপায় তোমাকে চা-বাগানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া।
না। চিৎকার করে উঠল দীপা।
পয়সা খরচ করে কেউ দুর্নাম কিনতে চায় না।
আমি এমন কিছু করিনি। যাতে তোমার দুর্নাম হয়।
অমরনাথ হাতে ধরে থাকা চিঠিটা নাড়ালেন, এটা পড়েও বলছ?
দীপা দিশাহারা হয়ে গেল। সাঁতা, অমরনাথকে খুব কাহিল দেখাচ্ছে এখন। যদি জলপাইগুড়ি থেকে চলে যেতে হয় তাহলে ভবিষ্যতে নিজের পায়ে দাঁড়ানো যাবে না কখনও। সে কথা খুঁজে না পেয়ে বলল, বাবা, তুমি আমাকে বিশ্বাস করছ না?
অমরনাথের চোযাল শক্ত হল। তিনি কোন জবাব দিলেন না।
বাবা, আমি তো বড়দিকে কথাই দিয়েছি। এই কলেজে পড়ার সময় কোন ছেলের সঙ্গে আর কথা বলব না। তুমি আমাকে আর একবার সুযোগ দাও।
অমরনাথ এবার মুখ খুললেন, ব্যাপারটা শুধু আমার ওপর নির্ভর করছে না। যে ভদ্রলোক দয়া করে তোমার পড়ার খরচ দিচ্ছেন খবরটা নিশ্চয়ই তাঁর কানেও উঠেছে। তিনি যদি সেটা বন্ধ করে দেন তাহলে——।
তিনি তো তোমাকে কিছু বলেননি এখনও।
তা বলেননি–।
যদি কিছু বলেন তাহলে আমি তাঁর কাছে যাব। সব বুঝিয়ে বলব।
চকিতে সোজা হয়ে বসলেন অমরনাথ, না না। ওখানে তুমি যাবে না। মিস্টার রায় সেটা কখনই পছন্দ করবেন না।
অমরনাথের এই প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করার মত মানসিক অবস্থা দীপার ছিল না। তার দু গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। অমরনাথ চোখ তুলে মেয়েকে দেখলেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, কান্নার কোন দরকার নেই।
চকিতেই বাবার সেই কথাগুলো মনে পড়ল। বাবা বলতেন, রক্তের চেয়ে চোখের জল অনেক বেশী মূল্যবান। কিন্তু আজ সেই কথাগুলো বললেন না।
দীপা আচিলে মুখ মুছল। তারপর কাঁপা গলায় বলল, তুমি যদি চাও তাহলে একবার বড়দির সঙ্গে কথা বলতে পার।
অমরনাথ মাথা নাড়লেন, আমার কারো সঙ্গে কথা বলার দরকার নেই।
কিন্তু তুমি আমাকে বিশ্বাস করছ না বাবা?
ঠিক আছে। তুমি যা বলছি তা যেন সত্যি হয়, সেইটে দেখো। ব্যাঙ্ক থেকে তোমার নামে টাকা এসেছে? অমরনাথ উঠে দাঁড়ালেন।
হ্যাঁ। অত টাকা আমার দরকার নেই।
যা দরকার তা রেখে বাকিটা তোমার মাকে, দিয়ে দাও।
দীপা ইতস্তত করল একটু। অমরনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু বলবে?
না। মানে, ওই টাকা তো মিস্টার বায়ের অফিস থেকে আমার পড়াবা জন্যে আসছে। ওঁকে বললে হয় না। কম টাকা পাঠাতে?
উনি মনে করেন অতটাই তোমার দরকার। তোমার প্রয়োজন না থাকলে তুমি যা ইচ্ছে তাই করতে পার। এ বিষয়ে, কথা বলতে গেলে উনি নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত হবেন। বড়লোকের খেয়াল বলে কথা।
তাহলে দাঁড়াও, আমি এনে দিচ্ছি। দীপা দ্রুত বেরিয়ে গেল। এখন তাকে অনেক সহজ দেখাচ্ছে। অমরনাথ চিঠিটাকে পকেটে রাখলেন। হাতের লেখা দেখে বোঝার উপায় নেই কে লিখেছে। তবে খামেব ওপর জলপাইগুড়ি পোস্ট অফিসেব ছাপ ছিল। সেইটেই স্বাভাবিক। কিন্তু ওটা পাওয়ার পর থেকেই মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল তাঁর। এখন মেয়ের পরিবর্তন দেখে একটু ভাল লাগছে। দীপা ফিরে এল প্ৰায় দৌড়েই। তার হাতে বেশ কয়েকটা দশ টাকার নোট। অমরনাথ মেয়েকে বসতে বলে কাগজ কলম বের করলেন। দীপার যা যা প্রয়োজন তা আর একবার হিসেব করা হল। দেখা গেল একশ টাকা হলেই পুরো খরচ মিটে যায়। দীপা বাকি টাকাগুলো অমরনাথের হাতে দিতে তিনি সেটা পকেটে রেখে দিলেন। এবং এই সময় দীপার আনার কথা মনে পড়ল। সে বলল, জানো, এর মধ্যে একদিন আমি খুব চমকে গিয়েছিলাম?
অমরনাথ মুখে কিছু না বলে গম্ভীর মুখে অপেক্ষা করলেন। আসলে সেই মুহুর্তে তিনি এক লজাবোধে আক্রান্ত ছিলেন.। মেয়েকে টাকা দেওয়ার বদলে মেয়ের টাকা তিনি নিচ্ছেন, এইটে বড় খোঁচা দিচ্ছিল। চেক নেওয়া, ব্যাঙ্কে জমা দেওয়ার মধ্যে প্ৰত্যক্ষ প্ৰাপ্তি ছিল না।
দীপা বলল, হঠাৎ আনা নামের সেই কাজের মহিলা এই হোস্টেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল।
আনা? অমরনাথ চমকে উঠলেন।
যে আমাকে ওই বাড়ি থেকে পালাতে সাহায্য করেছিল। কি বিরাট চেহারা হয়েছে, মোটাসোটা, কাজের লোক বলে আর চেনাই যায় না।
আনা। এখানে এসেছিল? বিড়বিড় করলেন অমরনাথ।
হ্যাঁ। কিন্তু আমি এখানে আছি তা ও জানল কি করে?
জেনেছে নিশ্চয়ই।
ও এসেছিল তোমার খবর নিতে। তোমার সঙ্গে ওর কি দরকার?
অমরনাথ নার্ভাস বোধ করলেন। আনাব ওপর অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে উঠলেন তিনি। তার এখানে আসার কি দরকার ছিল! দীপা দেখল। অমরনাথ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছেন। সে দ্বিতীয়বার প্রশ্নটা করল। অমরনাথ সজাগ হলেন, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। ব্যানার্জী মশাই-এর শরীর খারাপ হল কি না কে জানে! আর তুমি যে এখানে আছ তা হরদেব দেখে গিয়েছেন। খবরটা তিনিই দিতে পারেন। তোমার এখানে না এসে আমাকে চিঠি দিতে পারত!
কেন? দীপার মুখে বক্ত জমল, তোমার সঙ্গে কিসের সম্পর্ক? কে অসুস্থ কি না তা তোমাকে জানাতে হবে কেন? ও বাড়ির সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই তা তুমি জান না? আমি ভাবতেই পারি না। এসব। নেহাত ওই কাজের মেয়েটা আমার উপকার করেছিল সেদিন তাই আমি খারাপ ব্যবহার করতে পারিনি।
দ্যাখ মা, সবসময় স্মৃতি আঁকড়ে বসে থাকতে নেই।
তুমি কি বলতে চাইছ?
অতীতে ওঁরা অন্যায় করেছিলেন, আমরাও যোগাযোগ রাখিনি। সম্পর্ক যা ছিল তা শুধু বলার জন্যেই। তোকে পরীক্ষা দিতে হয়েছে কলেজে ভর্তি হতে হয়েছে ওদের উপাধি নিয়ে। কিন্তু দিন আর নদীর জল সবসময় সমান বহে যায় না। খবর তো আমারও কানে আসে। ব্যানার্জী মশাই পক্ষাঘাতে পঙ্গু এখন, ওঁর স্ত্রী উন্মাদাশ্রমে। সংসার ছাড়খার হয়ে গিয়েছে। এখন বিষ তো দূরের কথা, ছোবলও নেই। অমরনাথ কথাগুলো বলতে বলতে মেয়ের দিকে তাকাচ্ছিলেন। কিন্তু মেয়ের মুখে কোন পরিবর্তন দেখতে পেলেন না।
দীপা বলল, যেমন কর্ম করেছে তেমন ফল পাচ্ছে। কিন্তু তাতে আমাদের কি? তুমি ওদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখবে না বলে দিলাম। আর আমার কাছে যদি কেউ আসে তাহলে আমি মুখের ওপর কথাটা বলে দেব।
দীপা, তুই কি এখনও ব্যাপারটা ভুলতে পারছিস না?
তুমি কি বলছি বাবা? আমি কোনদিন ভুলতে পারব! তোমরা আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছিলে, আমার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিতে চেয়েছিলে–
কি বলছিস তুই? আমি জেনেশুনে তোর ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে চেয়েছিলাম? এমন কথা তুই উচ্চারণ করতে পারলি? অমরনাথের গলার স্বর পাল্টে গেল।
দীপা মাথা নাড়ল, আমার কি ক্ষতি হয়েছে তুমি জানো না? বন্ধুবান্ধবদের পর্যন্ত ব্যাপারটা বলতে পারি না। সবাই জানে আমি কুমারী। ব্যাপারটা ভাবলেই বমি পায় আমার। আর তুমি এখন ওদের হয়ে নরম নরম কথা বলতে এসেছী। তোমার ওপর আমার রাগ হওয়া অন্যায়? তুমি বল?
অমরনাথ হাসার চেষ্টা করলেন, দ্যাখ। দীপা, রাগ করে দূরে থেকে নিজের কোন লাভ হয় না। আমি প্ৰতিশোধ নিতে চাই। তোর ওপর যে অত্যাচার হয়েছে তার দাম দিয়ে যেতে হবে প্রতুল ব্যানার্জীকে। আমি সেই চেষ্টাই করছি।
দীপা অবাক হয়ে তাকল, দাম? ওই অন্যায়ের কি দাম হতে পারে?
দেখি! অমরনাথ মাথা নিচু করলেন, অনেক চিন্তা করার আছে। ঠিক আছে, ভালভাবে থাকিস। আজ আমি চলি।
অমরনাথ গেস্টরুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির ধাপে পা রাখতেই দীপা পেছন থেকে ডেকে উঠল, বাবা! অমরনাথ মুখ ফেরালেন না।
দীপা এগিয়ে এল, আমার কোন দাম দরকার নেই।
অমরনাথ মাথা নাড়লেন, শুনলাম।
তুমি কি এ কথাটা জানতে না?
জানি। কিন্তু জীবন তো কোন হিসেব মেনে চলে না। আজ যে অত্যন্ত ঘূণ্য শত্ৰু কাল যদি সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে তোর কাছে এক গ্লাস জল চায় তাহলে কি তুই মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবি। মানুষ হলে পারবি না। এটাই জীবনের নিয়ম। তোর কিছু চাই না, কিন্তু আমিও তো একইভাবে প্রতারিত হয়েছি, সে জ্বালা মেটাবার সুযোগ পেলে ছাড়ব কেন?
তুমি কি ওদের বাড়িতে যােচ্ছ? দীপা সরাসরি প্রশ্ন করল।
অমরনাথ একটু ইতস্তত করলেন, হ্যাঁ। আনা কেন এসেছিল তা জানা দরকার। হয়তো–! তাছাড়া তাকে নিষেধ করতে হবে, এখানে যেন আর না আসে।
অমরনাথ আর দাঁড়ালেন না। হন হন করে, হোস্টেলের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তাঁর যাওয়ার ধরন দেখে দারোয়ান পর্যন্ত অবাক হয়ে গেল। দীপা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল! তার কেবলই মনে হচ্ছিল অমরনাথ সত্যি কথাটা গোপন করছেন। আজ যে মেজাজ এবং চেহারা নিয়ে তিনি চিঠি পেয়ে ছুটে এসেছিলেন তার সঙ্গে চলে যাওয়ার সময় তার চেহারাদ্য কোন মিল নেই। প্ৰথম দিকে তিনি যেভাবে ক্ৰোধ প্ৰকাশ করেছেন শেষ দিকে যেন পালিয়ে গেলে বাঁচেন, এমন মুনে হচ্ছিল। জ্ঞান হবার পর সে অমরনাথকে ওই ভঙ্গী এবং ভাষায় কথা বলতে শোনেনি। আজ এক সম্পূর্ণ অচেনা অমরনাথ হোস্টেল থেকে পালিয়ে গেলেন। হ্যাঁ, বাবার যাওয়াবা ভঙ্গীটাকে পালানো বলাই ঠিক। বাবার সঙ্গে নিশ্চয়ই ওদের যোগাযোগ আছে। এটুকু ভাবতেই শরীর জ্বলতে লাগল। যোগাযোগ আছে বলেই আনা এসেছিল। প্রতুল ব্যানার্জীর পক্ষাঘাত হয়েছে, তার স্ত্রী উন্মাদ–এতে তার কিছু এসে যায়; না। কিন্তু বাবা কেন ওদের বাড়িতে যাওয়া আসা করছে! দীপার ইচ্ছে হচ্ছিল এখনই চা-বাগানে ছুটে যেতে। অঞ্জলিকে সব কথা খুলে বললে বাবার পরিবর্তনেব কারণটা জানা যাবে। কিন্তু তখনই মনে হল, মা যদি তার কাছে লুকিয়ে যান? দীপা ভেবে পাচ্ছিল না কি করা উচিত!
থানার পাশ দিয়ে করলা নদীর ধার দিয়ে ঝোলনা ব্রিজের কাছে পৌঁছে অমরনাথের চেতনা পরিষ্কার হল। এতক্ষণ তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ছুটে আসছিলেন। মেয়ের হোস্টেলে যাওয়ার জন্যে আনাকে কটুকথা বলবেন। পারলে প্রতুলবাবুকেও কথা শোনাতে ছাড়বেন। না। যে সর্বনাশ তাঁরা এককালে করেছেন তার পুনরাবৃত্তি হতে দেবেন না তিনি।
কিন্তু ঝোলনা ব্রিজের ওপর উঠে মনে হল এরকম রাগের কোন মানে হয় না। সাত দিনের বদলে অনেক দিন হয়ে গেল। ব্যাপারটা নিয়ে তিনি অনেক ভেবেছেন। বীরপাড়া চা-বাগানের গুদামবাবুর ভায়রাভাই উকিল। ভদ্রলোক শালির বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। তাঁর সঙ্গে দেখা করে অমরনাথ সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলেছেন। তিনিও বলেছেন, প্রতুল বন্দোপাধ্যায় যদি উইল করে কাউকে দিয়ে না যান তাহলে সমস্ত সম্পত্তির কনম্বব উত্তবাধিকারিণী দীপা। কিন্তু আনা যেখানে আছে সেখানে উইল হবেই। তিনি না গেলে আনা অন্য কাউকে ধরতে পারে। গোডালিতে ফোস্কা পড়ছে বলে কোন মুর্থ বলে না যে সে জুতো ব্যবহার করবে না। আনার দেওয়া প্রতুলবাবুর তৈরীি উইলের খসড়া থেকে সম্পত্তির যে হিসেব পাওয়া গিয়েছিল তাই উকিল ভদ্রলোককে দিয়ে দিয়েছিলেন অমরনাথ। কথা ছিল তিনি সব কিছু লিখে স্ট্যাম্প পেপারে টাইপ করিয়ে রাখবেন। ভদ্রলোকের বাড়ি এই করলা নদীর ধারে জলপাইগুড়ি গার্লস স্কুলের পাশেই।
অমরনাথ পথ পবিবর্তন করে জিজ্ঞাসাবাদ করে উকিলবাবুর বাড়িতে পৌঁছালেন। ভদ্রলোক তখনও বাইরের ঘরে মক্কেলদের নিয়ে বসে। অমরনাথকে ঢুকতে দেখে মাথা নেড়ে বললেন, বসুন। অমরনাথ কোণাব দিকে একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসলেন। মকেলদের সঙ্গে কথাবার্তা সাবতে আধা ঘণটা সময় লাগল; অমরনাথ দেখলেন একজন মক্কেল যাওয়ার সময়। কৃডিটি টাকা দিয়ে গেল। উকিলবাবু ডাকলেন, আসুন আপনি আপনার তো অনেকদিন আগেই আসার কথা। দেবি হচ্ছে দেখে গতকালই আমার ভায়রাভাইকে একটা চিঠি দিয়েছি। কি ব্যাপার মশাই?
নানারকম ঝামেলায় আটকে পড়েছিলাম।
শুনুন, এ যা সম্পত্তি তার তুলনায় কোন ঝামেলাই ইমপটেন্ট হতে পারে না! আচ্ছা, এই আনা মহিলাটিকে অংশ দিতেই হবে?
অমরনাথ অসহায় ভাবে মাথা নাড়লেন।
বুঝুন, বাড়ির ঝি সেবা করে মাথায় উঠছে। কাটানো যায় না?
কি ভাবে?
কাটাতে চান? তাহলে আমার ওপর ছেড়ে দিন।
অমরনাথ দ্বিধায় পড়লেন। আনাকে প্রতারিত করে পুরো সম্পত্তির দখল নিলে লাভ হয় নিশ্চয়ই কিন্তু মন সায্য দিচ্ছে না। তা ছাড়া সইসাবুদ তো আনাই প্রতুলবাবুকে দিয়ে করাবে। ব্যাপারটা জানতে পারলে সে অনর্থ করে ছাডবে। না, কারণ অভিশাপ থাকলে সম্পত্তি থেকে সুখ পারেন না তিনি। অমরনাথ মাথা নাড়লেন, দাবকার নেই, যেমন বলেছি তেমন করুন।
উকিলবাবু হাসলেন, আপনার যেমন ইচ্ছে। কাগজপত্র সব তৈরী করেই রেখেছি। তিনি উঠে আলমারির দরজা খুলে একটা ফাইল টেনে আনলেন, যত তাড়াতাড়ি পারেন পেন্সিলে টিক দেওয়া জায়গাগুলোয় সই করিয়ে আনুন। বাকি কাজটা আমি করে দেব।
অমরনাথ স্ট্যাম্প পেপারগুলো নিয়ে মন দিয়ে পড়তে লাগলেন। হ্যাঁ, সব ঠিকঠাক আছে। উকিলবাবু টেবিলের উল্টোদিকে বসেছিলেন। পড়া শেষ হলে আচমকা প্রশ্ন করলেন, আপনি হরদেব ঘোষালকে চেনেন? আপনার বেয়াই মশাই-এর বন্ধু!
চমকে উঠলেন অমরনাথ। পরীক্ষণেই মনে পড়ল কোর্ট কাছারিতে ঘোরাঘুরি করা হরদেবের নেশা। একই শহরের লোক সেই সূত্রে পরিচিত হতেই পারে। তিনি মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ।
ভদ্রলোকের কাছে প্রতুলবাবুর কাহিনী শুনলাম। ওই আনা মেয়েটা তো মুঠোয় করে রেখেছে তাকে। খুব সুন্দরী নাকি?
না। তেমন নয়।
তাহলে নিশ্চয়ই স্বাস্থ্য ভাল। হা হা শব্দ করে হাসলেন উকিলবাবু, হরদেব বাবুর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কি রকম?
আলাপ আছে।
উঁহ, মনে হল আরও বেশী কিছু। যাক, আর দেরি করবেন না।
একটু ইতস্তত করে অমরনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি হরদেবকে এই উইলের কথা কিছু বলেছেন?
না মশাই। সেই বুদ্ধি না থাকলে ওকালতি করে খেতে পারতাম না। লোকটা একটা শেয়াল, খ্যাক শেয়াল বললেও কম বলা হয়। আমার মক্কেল আপনি, সে নয়।
অমরনাথ খুশী হলেন, কত দিতে হবে?
আমাকে? দুলে দুলে নিঃশব্দে হাসতে লাগলেন উকিলবাবু, রাজার সম্পত্তি পেতে চলেছেন। এখনই কিছু দেওয়ার দরকার নেই। তবে পাওয়ার আগে আঙুলগুলো আর মুঠো করবেন না, তাহলেই হবে। পারলে আজই সই করিয়ে আনুন।
তবু যদি একটা আন্দাজ দেন।
আরে মশাই, এখন আপনার পকেটে যা আছে তাতে আমার কোন আসক্তি নেই। আমি আমারটা ঠিক সময়মত আপনার কাছে চেয়ে নেব। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে কোর্টে চলে আসবেন। উকিলরা যেখানে বসে সেখানে খোঁজ করলে পেয়ে যাবেন।
ঝোলনা ব্রিজ পেরিয়ে হাকিমপাড়ায় ঢুকলেন অমরনাথ। এত শান্ত এলাকা যে মনেই হয় না শহরে এসেছি। চারপাশে নজর রেখে তিনি এগোচ্ছিলেন। তাঁর ভয় হচ্ছিল পথে হরদেবের সঙ্গে দেখা না হয়ে যায়। কিন্তু প্ৰতুল বন্দোপাধ্যায়ের বাড়ির গেট পর্যন্ত আসতে কোন বিঘ্ন ঘটল না। বাগানের ভেতরে পা দিতেই গন্ধটা নাকে এল। বাঁ দিকে একটা স্বাস্থ্যবান মাঝারি উচ্চতার গাছে পদ্মের মত সুন্দর ফুল ফুটেছে। একটু চিন্তা করে নামটা মনে করতে পারলেন তিনি, গ্ল্যান্ডিফ্লোরা। গন্ধে বুক ভরে যায়। ফুল ফোটে তার সময়মত শুধু মানুষের সময়টায় কোন হিসেব থাকে না।
সদর দরজা যথারীতি বন্ধ। চট করে মনে হয় কেউ বাস করে না। অমরনাথ দরজায় শব্দ করলেন কয়েকবার কিন্তু সাড়া মিলল না। প্রতুলবাবু নিশ্চয়ই মারা যাননি। এই ছোট্ট শহরে প্রতুলবাবুর মত মানুষ মারা গেলে মুখে মুখে খবর ছড়াতো। হঠাৎ অমরনাথের মনে হল উইলটুইল করার আগেই যদি প্রতুলবাবু চলে যান তাহলে আনাকে এক পয়সাও দিতে হবে না। সমস্ত সম্পত্তি আইনমোতাবেক দীপাই পারে। মরে গেল নাকি? পরীক্ষণেই মাথা নাড়লেন তিনি। কিছু বিশ্বাস নেই, কোথেকে একটা উইল বেরিয়ে পড়বে আর চোখে ধুতরো ফুল দেখতে হবে। যত যাই হোক, কোন মানুষেব মৃত্যু কামনা করা ঠিক নয়।
শেষ পর্যন্ত মনে পড়ল!
গলাটা শুনেই চমকে ফিরে তাকালেন অমরনাথ। বাগানের রাস্তান্য দাঁড়িয়ে আছে আনা। কে বলবে বাড়ির বি। শরীর স্বাস্থ্য যেন আরও ঝকমকে। স্নান করেছে বলে আরও টাটকা দেখাচ্ছে। হাতে ফুলের সাজি। ফুল তুলতে বেরিয়েছিল। পেছনের দরজা দিয়ে।
অমরনাথ আমতা আমতা করলেন, সব কিছু তৈরী করতে দেরি হয়ে গেল!
আমি হনুমান নাকি যে সূর্যকে বগলে আটকে রাখব? এই সময়ে তিনি যদি স্বৰ্গে চলে যেতেন তাহলে ওই তৈরী করা কাগজ আমার কোন কাজে লাগত?
অমরনাথ হাসলেন, শেষ ভাল যার সব ভাল। এখন সব তৈরী।
আসুন। এদিক দিয়ে। সদর খোলা নেই। কথাগুলো বলে আনা বাগানের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে লাগল। ওকে অনুসরণ করে প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি অমরনাথ হঠাৎ শিহরিত হলেন। আজকাল অঞ্জলির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক দৈবাৎ হয়। তাঁর বাসনা অঞ্জলির নির্লিপ্তির কাছে চাপা পড়ে যায়। কোথায় যেন পড়েছিলেন, বাঙালি মেয়েদের মন পয়ত্ৰিশের এপাশে চলে এলেই শরীর নিবিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চায়। অথচ আনার বয়স চল্লিশের এদিকে তো নয়ই। কিন্তু হাঁটার ধমকে সমস্ত শরীরে ঢেউ বয়ে যাচ্ছে তার। নিজেকে সংযত করতে প্ৰাণপণে চেষ্টা করছিলেন অমরনাথ। দেশটা বিলেত আমেরিকা নয়। বাঙালি পুরুষ যদি বিবাহিত এবং সন্তানের পিতা হয় তাহলে মনের মধ্যে এক সন্ন্যাসীকে ধরে রাখা অবশ্য কর্তব্য।
পেছনের বারান্দায় পৌঁছে একটা মোড়া এগিয়ে দিল আনা, বসুন। অমরনাথ বসলেন। সাজিটা রেখে দিয়ে এসে আনা বলল, ওমা, আপনার কি শরীর খারাপ মুখচোখ অমন হয়ে গিয়েছে কেন?
অমরনাথ দ্রুত মাথা নাড়লেন, না, না। কিছু হয়নি।
আনার ঠোঁটে হাসি চলকে উঠল, না হলেই ভাল। কই দিন।
অমরনাথ উকিলবাবুর তৈরী উইল এগিয়ে দিলেন। আনা সেটাকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, চা দেব, না সরবত?
অমরনাথ বললেন, কিছু না। আমি খেয়েই এসেছি।
এসেছেন তো চা-বাগান থেকে। এতক্ষণে সব হজম হয়ে গেছে।
না, না, আমার কিছু প্রয়োজন নেই। প্রতুলবাবু কেমন আছেন?
শালগ্ৰামশিলা।
মানে?
নড়াচড়া করতে পারে না যে তাকেই পুজো করতে হয়। আপনার সঙ্গে এব। মধ্যে হরদেবের দেখা হয়েছিল?
না তো।
আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না। আপনার দেরি হচ্ছে কেন? খোঁজ নিতে মেয়ের কলেজে গিয়েছিলাম। সে তো এখন দিব্যি হয়েছে।
হুঁ! তবে আজকালকার মেয়ে তো, এ বাড়ির সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখতে চায় না।
সেটা অ্যাদ্দিন চাইত না। এখন সম্পত্তি পারে, না চাইলে চলে?
ও যে এসব পাচ্ছে তা জানে না।
জানে না মানে?
এ বাড়ির কোনকিছুর সঙ্গে ও যোগাযোগ নেই বলে জানে।
এই যে উনি অতগুলো টাকা দিলেন পড়ার খরচ চালাতে?
অমরনাথ মুখ তুলে তাকালেন। আনার মুখে বিস্ময়। এই মহিলার কাছে প্রতুলবাবু কোন কিছুই গোপন রাখতে শৈষ পর্যন্ত পারেন না। তিনি নিচু স্বরে বললেন, সেটা ব্যাঙ্কে আছে। ব্যাঙ্কই পাঠাচ্ছে। দীপা জানে না!
কদিন ধামাচাপা দিয়ে চালাবেন?
দেখি। অমরনাথ উঠলেন, প্ৰতুলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে পারি?
দাঁড়ান। উনি এখন উদোম হয়ে পড়ে আছেন। চাদর টেনে দিই তারপর যাবেন। আনা ঘরে ঢুকে গেল। তাজব হয়ে গেলেন অমরনাথ। অসুস্থ একটি মানুষ কেন বিবস্ত্ৰ হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকবে? পেচ্ছপ বাহ্যি করাচ্ছিল নাকি? তা তো নয়, আনা তো বাগানে ফুল তুলছিল! ব্যাঙ্কের ব্যাপারটা না বলাই উচিত ছিল।
মিনিট খানেক বাদে প্রতুলবাবুর খাটের পাশে বসেছিলেন অমরনাথ।
চিনতে পারছেন?
না পারার কোন কারণ নেই। প্রতুলবাবুর গলার স্বর মিনমিনে কিন্তু স্পষ্ট। শরীর শুকিয়ে প্রায় দড়ির মত হয়ে গিয়েছে। মুখ এবং বাইরে বেরিয়ে থাকা দুটো হাত দেখে সেটা বোঝা যায়। বাকি শরীর সাদা চাদরে ঢাকা। অমরনাথ অনুমান করলেন সেটি আনা এখনই ঢাকা দিয়েছে। আজ প্রতুলবাবু ঘাড় ঘোরাতে পারছেন না বলে মনে হল। তার মুখ ছাদের দিকে স্থির। চোখ ঘুরছে।
মেয়ে কেমন আছে? সেই অবস্থায় প্রশ্ন করলেন প্রতুলবাবু।
ভাল। কলেজে পড়ছে।
জলপাইগুড়িতেই তো আছে, দেখতে বড় সাধ হয়। প্রতুলবাবুর মুখ থেকে কথাগুলো বেরুতেই আনা বলল, এখন আর সাধ হলে কি হবে।
কি নাম যেন রাখা হয়েছিল? আশা, আশালতা। সেই নাম আর নেয়নি, না?
আনাই জবাব দিল, না।
প্রতুলবাবু বললেন, আমি খুব শিগগির যাচ্ছি না। সে কি আসবে?
দেখি। অমরনাথ বলতে পারলেন।
এবার আনা বুকে তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে কিছু বলল। প্রতুলবাবু চোখ ঘোরালেন, আমাকে আপনারা ক্ষমা করেছেন?
অতীতের ওইসব ব্যাপার। ভুলে যাওয়াই ভাল।
প্রতুলবাবুর মুখে হাসি ফুটল, একটা কথা রাখবেন?
বলুন।
আমি চলে গেলে আপনি আনুকে একটু দেখবেন।
অমরনাথ মুখ তুলতেই আনার ঠোঁটে হাসি খেলে গেল। প্রতুলবাবু হাত তুলতে চেষ্টা করছিলেন। সাদা চাদরটস সরে যাচ্ছিল। আনা প্ৰায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠিক করে দিল সেটা। প্রতুলবাবু বললেন, আর ঢেকে কি হবে। এসেছি যেভাবে যাব সেইভাবে। হাত নেতিয়ে পড়ল শরীরের পাশে।
আনা ইশারা করল বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে। অমরনাথ বললেন, চলি। প্রতুলবাবু সাড়া দিলেন না। চোখের পাতাদুটো বন্ধ হল মাত্র।
বাইরের ঘরে পৌঁছে অমরনাথ ছটফট করতে লাগলেন। উইলটা সই কারাবার কোন চেষ্টাই আনা করল না। লোকটাকে পেছন থেকে ধরে বসিয়ে দিলে নিশ্চয়ই সই করতে পারবে। এখন সই হয়ে গেলে তিনি কোর্টে গিয়ে উকিলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে পারতেন। উইল আইনসঙ্গত করতে কত খরচ পড়বে তিনি জানেন না। আজ না হলে তাঁকে আর একদিন আসতে হবে। এইরকম খুচরো ছুটি পাওয়াও তো মুশকিল।
পায়ের শব্দে মুখ ফেরালেন তিনি। আনা বলল, দাঁড়িয়ে কেন? বসুন।
না, না। যেতে হবে। অমরনাথ ব্যস্ততা দেখালেন।
আনা হাসল, উনি চলে গেলে আমার দায়িত্ব নিতে বললেন আপনাকে, কই, আপনি তো কোন জবাব দিলেন না?
কি বলব? মুখ ঘোরালেন অমরনাথ।
হরদেব ঘোষাল হলে কিন্তু বিশ্বরূপ দেখানোর মত হ্যাঁ করত।
অমরনাথ অস্বস্তিতে পড়লেন। হরদেব নাকি একসময় আনার শরীরের দিকে নজর দিয়েছিল। তাঁকে আর হরদেবকে আনা একই চরিত্রের মনে করছে না কি! আজ হাঁটার ভঙ্গী দেখে কয়েক সেকেণ্ড চঞ্চলত এসেছিল, সেটা কয়েক সেকেণ্ডই। হঠাৎ আনা হাত ঘুরিয়ে বলল, না, বাবা, আমার দায়িত্ব কাউকে নিতে হবে না। অ্যাদ্দিন দেখলাম যখন তখন চিতায় ওঠার আগে ঠিকই টিকে থাকতে পারব।
অমরনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, উইলটা সই করিয়ে নিলে আজই কোর্টে যাওয়া যেত।
আন হাসল, আমি তো ইংরেজি পড়তে জানি না। যাচাই করে নিই। আপনি ঠিকঠাক লিখিয়েছেন কি না। আমার ভাগটা ঠিকমত লেখা আছে কি না। পুরুষমানুষকে আমি বিশ্বাস করি না।
২২. একতারা বাজিয়ে গান
হিত্তি গেনু, হুত্তি গেনু, গেনু জলপাইগুড়ি/ জলও নাই, গুড়িও নাই পাইতে সুড়সুড়ি/ নিজের চোখুত দেখি আসিনু শহরটার ঢক/ নামের বাহার অফুলা শাক, মানষিলায় ঠক।
বিষণ্ণ চেহারার একটি মানুষ একতারা বাজিয়ে গান গাইছিল কিং সাহেবের খাটে বসে। সামনের। বালির চরে পন্থীরাজ ট্যাক্সিগুলো জিরোচ্ছে। এ পাশে করলা আর তিস্তার মিলনমুখে কিছু দোকান, চা সিঙ্গাডার আর ঘাটবাবুদের। এখন ভরদুপুর। কলেজ থেকে জনা চারেক মেয়ে আচমকা ছুটি হওয়ায় তিস্তা দেখতে এসেছিল চুপিসারে। আর এসেই ওরা ওই গানটা শুনল।
জলপাইগুড়ি জেলার মানুষের বাংলা কলকাতার থেকে আলাদা। তা কোন জেলাব ভাষাই বা ঠিকঠাক মিলে যায় কলকাতার সঙ্গে? এতদিন চালু ছিল কামরূপী। আর বঙ্গলা—বরেন্দ্রী মিশ্রিত এক ধরনের বাবু বাংলা। কামরুপী বলেন রাজবংশী এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ। দেশ বিভাগের পর এই বারো বছরে ব্যাপারটা ওলট পালট হয়ে যাওয়ার মুখে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষেরা বিশেষ করে বগুড়া, রাজশাহী, পাবনা আর মৈমনসিংহ থেকে আগত শরণার্থীরা জলপাইগুড়ি শহরের প্রান্তে পত্তন করলেন উদ্বাস্তু কলোনির। মাসকলাইবাড়ি বা পাণ্ডাপাড়ায়, সেই কলোনি সীমাবদ্ধ থাকল না, সস্তা চাষের জমি এবং বসতজমি পাওয়ায় তাঁরা ছড়িয়ে পড়লেন ড়ুয়ার্সের গ্রামে গ্রামে, অরণ্যে। এবার কামরুপী এবং বঙ্গালী-বারেন্দ্রীর সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের ওইসব জেলার ভাষা যা কিনা প্ৰত্যেকেরই প্ৰায় আলাদা চেহারা, মিলে মিশে একটা বাংলা ভাষা চালু করতে চাইছে যার ক্রিয়া পদে পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব, শব্দভাণ্ডারে কামরূপী ভাষার প্রচুর অস্তিত্ব এবং পরিবেশনে কলকাতার বাবু বাংলার ছায়া স্পষ্ট। মাত্ৰ বারো বছরেই এই কাণ্ড। জলপাইগুড়ি আনন্দচন্দ্ৰ কলেজের অধ্যাপক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বলতেন, আমরা একটা চমৎকার ভাষা পেলাম কারণ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষরা বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছেন। যদি ওঁরা সবাই একই জেলা থেকে এখানে আসতেন তাহলে এ জেলার ভাষার অর্ধেকটাই হয়ে যেত। রাজসাহী বা মৈমনসিংহের।
অথচ চা-বাগানে দীপারা যে বাংলা বলত তাতে পূর্ববাংলার ভাষা যেমন ছিল না তেমনি কামরূপী ভাষার প্রভাবও পড়েনি। যেহেতু মুষ্টিমেয় কয়েকটি পরবারের বাস ছিল সেখানে এবং বহিরাগত মানুষও গল্প-উপন্যাসের চরিত্রের ভাষায় কথা বলতেন তাই দীপাদের বিপাকে পড়তে হয়নি। বরং মদেশিয়া অনেক শব্দ কথার মধ্যে ঢুকছিল। ঠাকুমা প্রায়ই সতর্ক করতেন শব্দ-উচ্চারণে গোলমাল হলে। অমরনাথ তো বাঙাল শব্দ শুনলেই রোগে যেতেন। অন্তত পরবারের মানুষের মুখে। হোস্টেলে এসে দীপা নিজের অজান্তে নতুন বাংলা বলতে লাগল সঙ্গিনীদের সংস্পর্শে। এখনও তাদের কলেজে শরণার্থী ছেলেমেয়েরা ভর্তি হয়নি, স্বাধীনতার আগে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে একধরনের বিনীতভাব ছিল, নতুন পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতেন তাঁরা, বেপরোয়াভাবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ছিল না। যেসব তরুণ পূর্ববাংলায় স্কুল শেষ করে এখানকার কলেজে দেশ বিভাগের পর ভর্তি হয়েছিল তাদেরও সম্ভবত নতুন পরিবেশে ভাষার জন্যে একধরনের সঙ্কোচ হত। এখন দীপাদের ক্লাসে যে কটি মেয়ে রয়েছে তাদের কেউ শরণার্থী নয়। অথাৎ এখনও সেই প্রজন্মের কলেজে পড়া শুরু হয়নি।
মানুষটি রাজবংশী। তাঁর ভাষা কামরূপী। দুই একটি শব্দ কানে প্ৰথমে অবোধ্য ঠেকলেও কয়েকবার উচ্চারিত হবার পর সহজ হল। দীপার সঙ্গিনীদের ওর গান শোনার চেয়ে কিং সাহেবের ঘাট দেখার দিকেই কৌতূহল বেশী। কিন্তু দীপাকে লোকটা টানছিল। গান শেষ হলে কাঁঠালগাছের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা চোখ মেলে মেয়েদের দেখল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে নিল। মানুষটির বয়স হয়েছে কারণ দাড়িতে রুপোর ঝিলিক। দীপা তার এক নতুন বান্ধবাঁ সরমাকে বলল, লোকটার সঙ্গে কথা বলব। আমার সঙ্গে যাবি?
সরমা সহজ মেয়ে। জলপাইগুড়ি শহরের সবরকম সংস্কার নিয়ে মানুষ। প্রিয় গায়কের দিকে তাকিয়ে সে ইতস্তত করল। দীপা বলল, নতুন স্যার বলছিলেন না যে দরবেশ বাউল ফকিরদের গানে সাধারণ মানুষের কথা ফুটে ওঠে। আমার ওঁর গান শুনে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছে কেন উনি জলপাইগুড়ির মানুষদের ঠিক বললেন।
কিছু যদি মনে করে? সরমা বলল।
কি মনে করবে? আমাদের চেয়ে অনেক বড়। প্ৰায় বাবার মত।
লোকটা কিন্তু ফকির না।
কি করে বুঝলি।
ফকিরদের এরকম পোশাক থাকে।
নতুন স্যার বলেছেন দেশজ গান থেকে অনেক প্রবাদ পাওয়া যায়। কয়েকটা পেয়ে গেলে কেমন হয় বলতো? চল না!
আনন্দচন্দ্র কলেজে সম্প্রতি যোগ দেওয়া এক অধ্যাপক বেশ আলোড়ন তুলেছেন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। তিনি শুধু যত্ন করেই পড়ান না, সাহিত্যের নানান খবর গল্প করে বলেন। ছেলেরা সম্ভবত নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের পর আর একজনকে বন্ধুর মত পেয়েছে। তাঁর নামে কাজ হল। সরমা এগোল। অন্য দুজন দূর থেকে দেখতে লাগল।
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দীপা জিজ্ঞাসা করল, এই গানটা আপনি বানিয়েছেন?
মানুষটি মৃদু মাথা নাড়ল। তার দাড়ি বাতাসে উড়ছিল, সেই ক্ষমতা কি দীনদয়াল আমাকে দিয়েছেন? আমি কুড়িয়ে কুড়িয়ে জমা করি বুকের মধ্যে। যখন ইচ্ছে হয় তখন গাই মা। এই গান কি তোমাদের ভাল লেগেছে?
হ্যাঁ। আপনি জলপাইগুড়ির মানুষদের ঠিক বললেন কেন?
মানুষ যদি ঠকায় তাহলে তাকে ঠক বলতেই হয়।
আপনি গানের সময় ওই ভাষায় গাইলেন, কথা বলছেন শুদ্ধ বাংলায়।
তোমরা তো বাবুদের বাড়ির মেয়ে। তাই তোমাদের বুঝতে সুবিধে হবে বলে বলছি। আর আমার ঘর ছিল নদীয়া জেলায়। ভাসতে ভাসতে অনেককাল এখানে ঠেকে আছি।
আপনি এরকম গান অনেক জানেন?
না মা। আমার পুঁজি অল্প। তবে এর প্রেমে পড়ে আছি। যা পাই তাই নিই। বাদ বিচার করি না। ত্রিস্সায় না জানে ঘাট কি আঘাট/ নিমদে না জানে ভাঙ্গা ঘাট/ পিরীত না বুঝে জাত কি অজাত। সুর করে নিচু গলায় গাইল লোকটা।
দীপা চটপট হাতের খাতা খুলল, আর একবার বলবেন?
কেন? লিখে রাখব। না মা, আমি লিখে রেখেছি মনে আর তুমি লিখবে খাতায়? সেটা কি মানানসই হল? মনে রাখতে পারলে রাখো। যদি থাকে মনত, হয়না ক্যানে দেশের কোনত, পিরীতি যদি মাচায় থাকে, দূর হলেই কি ভুলে তাকে?
আপনার মত স্মরণশক্তি নেই যে আমার।
কি করে বুঝলে? লোকে সুখের কথা ভুলে যায়, দুঃখের কথা ভুলতে পারে না। তুমি বাচ্চা মেয়ে। বুঝবে না এখন। কখনও যদি দুঃখের মত দুঃখ পাও দেখবে চেষ্টা করলেও ভুলতে পারবে না।
দীপার মুখ থমথমে হয়ে গেল। এ কথাটা কতখানি সত্যি তা সে জানে। সব কিছু ভোলা যায়। কিন্তু সেই ফুলশয্যার রাত্রের নরকটাকে কিছুতেই ভুলতে পারে না সে।
কিন্তু আপনি এখনও স্পষ্ট বললেন না কেন শহরের লোক ঠক?
লোকটা হাসল। তানপুরায় শব্দ করে মুখে বলল, ফুটানির রামা/ উপর ধুতি তলে জামা।
সরমা আর দীপা একসঙ্গে হেসে উঠল। দীপা সরমাকে বলল, এটা আমি কখনও ভুলব না। আপনি এরকম আর কয়েকটা বলুন না।
শহরের লোক বড় অহঙ্কারী। নিজের গুণ পাঁচমুখে বলে। এরা সব রাজার ঘরের বান্দী। কিন্তু, ছান ফ্যালাইতে দেখা যায় খোলা মাথায় চান্দি। লোকটা এবার হাসল, আচ্ছা! লিখে নাও তিনটে উপদেশ। আমার কথা না, এই জেলার মানুষেধ। পূর্ব-পুরুষদের মুখ থেকে শুনে শুনে মনে রেখেছে। কিন্তু মনেই রেখেছে কাজে তো করা যায় না। করতে চাইলেও না। লেখ। লোকটা চোখ বন্ধ করল। কিন্তু দীপা খাতা খুলল না। সরমা তাকে খোঁচা দিল। দিয়ে নিজের খাতা খুলল। লোকটি চোখ বন্ধ করে বলল, সুদিনের বাপ ভাই, নিদান কালে কহয় নাই। সুজনেরও ড়ুবে নাও হাতিরও পিছলে পাও। নয়া নয়া বথুয়া শাক নুন তেলে খায়, বুড়া হইলে বথুয়া শাক গড়াগড়ি যায়। ব্যাস। হয়ে গেল। এবার আমি চলি। কোন ভূমিকা না করেই লোকটা খেয়াঘাটের দিকে পা বাড়াল। ওরা দেখতে পেল খেয়াঘাটের সামনে পৌঁছানো মাত্র মাঝিরা লোকটিকে সাদরে নৌকোয় তুলে নিল। এক নৌকো মানুষ কিং সাহেবের ঘাট ছেড়ে রওনা হল বার্নিশ ঘাটের দিকে। হঠাৎ দীপার বুক টনটন করতে লাগল। ওর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। চা-বাগানে যেতে। এই পথ দিয়ে এক অপরাহুে সে এক অসুস্থ শরীরে চা-বাগানে গিয়েছিল। এখন তো সব চেনা। শনিবারে চলে গিয়ে সোমবার সকালে ফিরে আসা যায়। হাতখরচের পয়সা বাঁচিয়ে গাড়িভাড়া দেওয়া যায়। তবু অনেকদিন যাওয়া হয়নি। সেই পুজোর ছুটির আগে যাওয়ার কথাও নয়।
কোর্টের পাশ দিয়ে নেতাজী পুলের দিকে আসছিল ওরা। হঠাৎ কেউ একজন চিৎকার করতে লাগল, আশা মা, আশালতা মা। একটু দাঁড়াও।
দীপা প্রথমে খেয়ালই করেনি। ওর বন্ধুদের কারো ওই নাম নয়। কিন্তু কোর্টের প্রাঙ্গণ থেকে হস্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসা লোকটিকে দেখতে পেল সারমা। পেয়ে বলল, এই আমাদের থামতে বলছে। ওরা দাঁড়াল। হরদেব ঘোষাল ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে আসছে। দীপা তাকে চিনতে পারল। পেয়েই শক্ত হয়ে গেল।
হরদেব ততক্ষণে সামনে এসে পড়েছেন, এই যে আশা মা, দূর থেকে একঝলক দেখেই চিনতে পেরেছি। এদিকে কোথায় এসেছিলে? কোর্টে?
আপনি ভুল করছেন। আমার নাম দীপাবলী।
তা তো জানি। কিন্তু আমাদের পক্ষে বউমা তোমার নাম রেখেছিলেন। আশালতা। ভারি মিষ্টি নাম। তা তোমার বাবার খবর কি?
দীপা কি বলবে বুঝতে পারছিল না। বন্ধুরা, কলেজ এবং হোস্টেলের কেউ জানে না তার বিয়ে হয়েছিল। জানাবার সুযোগই হয়নি। সে বিধবা একথা বলার প্রয়োজনই বোধ করেনি। বন্ধুদের সে চেনে। সে বিবাহিতা এই খবর ওরা মেনে নিতে পারবে। কিন্তু যদি জানে বিধবা তাহলেই প্রতিক্রিয়া হবে। হিন্দু-বিধবা মেয়ে মাছ-মাংস খাচ্ছে, রঙিন শাড়ি পরছে, ছেলেদের সঙ্গে কথাবার্তা বলত, এটা হজম করা ওদের পক্ষে মুশকিল হয়ে পড়বে। সে বুঝতে পারছিল হরদেবের সঙ্গে তর্ক করলে সেই তথ্যটা এরা জেনে ফেলবে। অতএর মুখ ফিরিয়ে দীপা বলল, ভাল আছেন।
তা তো থাকবেনই। আমি তোমাকে কোর্টের দিকে দেখে ভাবলাম তুমি বুঝি উইল রেজিষ্টি করতে এসেছি। আচ্ছা মা, তুমিই বল, ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খেতে হয়?
আপনি কি বলছেন আমি বুঝতে পারছি না। কিসের উইল?
তুমি জানো না কি করে একথা বিশ্বাস করি বল?
দেখুন, আমাদের হোস্টেলের নিয়ম রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোন ছেলের সঙ্গে কথা বলা চলবে না। জানতে পারলে হোস্টেল থেকে বের করে দেবে। আপনি বরং আমাদের হোস্টেলের গেস্টরুমে এসে আমার সঙ্গে কথা বলবেন। করে আসবেন বলুন? দীপা এ ছাড়া কিছুই বলতে পারল না।
কবে আবার? আজই আসতে পারি। ঠিক আছে, তুমি এগোও, আমি আসছি। ঠিক কথা, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলা ঠিক নয়। হরদেব হাসল।
দ্রুত পা চালাল দীপা। বন্ধুরা কয়েক পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হরদেবের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব তৈরী হবার পর সরমা জিজ্ঞাসা করল, কে রে?
আমার বাবার পরিচিত।
ওসব কি বলছিল?
কিসব? দীপা নিজেই যেটা বোঝেনি সেটা সরমারা কতখানি বুঝছে জানতে চাইল।
ওই উইল টুইল। লোকটা যেন কেমন!
আর এক বন্ধু বলল, আমরা জানতামই না তোমার নাম আশালতা!
ধ্যাত। যত বাজে কথা।
ওমা, ওই লোকটা তোমাকে আশা আশালতা বলে ড়াকছিল। নাম না হলে কেউ মিছিমিছি। ডাকে। বলল না, আমাদের পক্ষে বউমা তোমার নাম রেখেছিল।
চতুর্থ জন বলল, আমাদের পক্ষে মানে? এসব তো বিয়ের ব্যাপারে বলে।
সরমা বলল, আমার মায়ের নাম আগে ছিল গোলাপ বিয়ের পাব ঠাকুমা রাখেন সুধা। বিয়ের পর হরদম নাম পাল্টে যেত। তোমার কি বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল?
মুখ গম্ভীর করে হাঁটছিল দীপা। এই সময় সত্যি কথাটা বলে দেবে ওদের? কাল সকালের মধ্যে খবরটা ছড়িয়ে যাবে চারপাশে। কিন্তু মিথ্যে কথা বললে সেটা যদি ফাঁস হয়ে যায়? এতদিন কেউ জিজ্ঞাসা করেনি বলে সে আগ বাড়িয়ে কিছু বলেনি। সেটা ছিল একরকম। এখন গলা ফুলিয়ে মিথ্যে বললে তো ধরা পড়লে আরও লজ্জা। সে মাথা নেড়ে বলল, হয়েছিল।
তারপর?
ছেলেটা অসুস্থ ছিল, মরে গিয়েছে। এটা সত্যি তবু কোথাও তো রাখা ঢাকা থাকল। দীপার কথা শেষ হওয়ামাত্র সরমা বলল, বাঁচা গেছে।
হরদেব কিন্তু এল না। দুদিন অপেক্ষা করে দীপা চা-বাগানে চিঠি দিল ঘটনার বর্ণনা দিয়ে। অমরনাথের কাছে জানতে চাইল ব্যাপারটা কি? অমরনাথ। এতদিন ঘটনার তিপ্রকৃতি বিশদভাবে অঞ্জলিকে বলেননি। মনোরমার কিছু জানা নেই। মেয়ের চিঠি পেয়ে অমরনাথ বুঝলেন আর চেপে রাখা যাবে না। কিন্তু এখন বলতে গেলে ওরা জানতে চাইবে ঘটনাটা কেন বলেনি আগে। অবশ্য অঞ্জলি প্রতুলবাবুর দেওয়া টাকাটার কথা জানে। অর্ধেক বলা আছে যাকে তাকেই তিনি বাকি ঘটনাটা রেখে ঢেকে বললেন।
অঞ্জলি স্বামীর দিকে তাকালেন, এসব কথা তুমি আগে বলনি কেন?
আমি অপেক্ষা করছিলাম। আসলে না আঁচালে তো বিশ্বাস নেই।
তার সঙ্গে আমাকে না বলার কি আছে! আমি তোমাকে ঠিক বুঝতে পারছি না। সত্যি ব্যাপারটা খুলে বল। অঞ্জলি সন্দিগ্ধ গলায় বলল।
যা বললাম। তাই সত্যি! আসলে আমার মনে হচ্ছিল এই যে সম্পত্তির জন্যে যাওয়া আসা করছি, এসব শুনলে তুমি আমাকে খুব লোভী ভাববে। একথা ঠিক, মেয়ে বিধবা হবার পর আমরা সম্পর্ক রাখিনি কিছুদিন। ওরা যেভাবে লুকিয়ে বিয়ে দিয়ে মেয়ের সর্বনাশ করেছে তাতে মুখদর্শন করাত পাপ। তোমার মেয়েরও তাই ধারণা। কিন্তু সব পাপের তো একটা প্ৰায়শ্চিত্ত করার নিয়ম আছে। প্রতুলবাবু যদি সম্পত্তি তার বউমাকে দিতে চান তাহলে চাইতে পারেন। নেওয়া না নেওয়া আমাদের ইচ্ছে। কিন্তু চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার কোন মানে হয়? দীপা ওই সম্পত্তির ন্যায্য উত্তরাধিকারী। তাকে সম্পত্তি পাইয়ে দিয়ে আমি কি কোন অন্যায় করছি?
তোমার মেয়ে যদি না নেয়?
না নিলে কাউকে দান করে দেবে। তাহলে অন্তত বারোভূতে লুটেপুটে খাবে না?
কত টাকার সম্পত্তি?
লক্ষ লক্ষ টাকা!
অঞ্জলি উত্তরটা শুনে চুপ মেরে গেল। অমরনাথ বললেন, আমার কি! মেয়ে যদি ভোগ করতে চায় করবে না। চাইলে ছেড়ে দেবে। আমি তো আর ভাগ বসাতে যাচ্ছি না। কিন্তু এই হরদেব লোকটা এসব বলতে গেল কেন? উইলের কথা তো আমি তাকে বলিনি।
লোকটা কেমন?
খুব খারাপ। প্রতুলবাবুর সেই টাকা থেকে কমিশন নিয়েছে। আনার ওপর নজর ছিল।
আনা! প্রতুলবাবুর সেই ঝি যে দীপাকে সাহায্য করেছিল?
হ্যাঁ। সেই তো এখন সমস্ত কিছু দেখাশোনা করছে। প্রতুলবাবুর পাশে সে একা আছে। আনা যা চাইবে তাই হবে।
আনা কি চায়?
সম্পত্তির ভাগ। আমাকে বলল একটা উইল করে নিয়ে যেতে। করলাম। তা পরীক্ষা না করিয়ে সই করাবেন না। তিনি প্রতুলবাবুকে দিয়ে।
সরাসরি প্রতুলবাবুর সঙ্গে কথা বলছি না কেন?
তিনি তোমার মেয়েকে দেখতে চান।
ঠিক আছে, এবার যখন তুমি জলপাইগুড়িতে যাবে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেও। আমি দীপাকে বুঝিয়ে বলব। আর হ্যাঁ, ওই আনার কাছে তোমার এক যাওয়ার দরকার নেই।
অমরনাথ স্ত্রীর দিকে তাকালেন, জঙ্গলের অন্ধকারে শহরের বিদুষী সুন্দরীকে সাইকেলের পেছনে বসিয়ে এনেছি চরিত্র মুঠোয় করে ধরে, তাতেও তোমার বিশ্বাস হল না?
অঞ্জলি মাথা নাড়ল, পুরুষমানুষের আবার চরিত্ৰ! বাজে বকো না তো। খুঁটি বাঁধা বকনা। খুঁটি উঠে গেলে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
কিন্তু এ যাত্রায় অমরনাথ স্ত্রীকে নিয়ে এলেন না। হরদেবের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হবে। সেইসময় স্ত্রীলোক সঙ্গে থাকলে বিপত্তি হবে। দীপার ছুটির সময় হয়ে এসেছে। বড়দি যদি অনুমতি দেন তাহলে তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছে অঞ্জলি।
কিং সাহেবের ঘাটে নেমে কোর্টের দিকে পা না বাড়িয়ে অন্য রাস্তা ধরলেন তিনি। তিস্তার গায়ে বাঁধ বাঁধা হচ্ছে। ভয়ঙ্করীকে সরকার এবাবে বেধে ফেলবে। ওপাশে নদীর ওপর ব্রিজ হয়ে গেলে ড়ুয়ার্স এক দৌড়ে কাছে এসে যাবে। ট্রেন চলবে বাস চলবে। আর ওই নৌকো আর পাখীরাজ টাক্সিগুলো উধাও হয়ে যাবে। কাজকর্ম দেখে মনে হচ্ছে। আর বেশী দিন নেই। নির্জনে পথ চলে অমরনাথ চলে এলেন হাকিমপাড়ায়।
প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে ঢুকে সদরে না গিয়ে বাগানের পথ ধরে পেছনে এসে গলা খুললেন তিনি, কেউ আছেন?
সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়িঙ্গে গোছের এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এল, অ! আপনি।
এই লোকটিকে বাগানে কাজ করতে দেখেছিলেন অমরনাথ একসময়। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার। আর সব কোথায়?
আর সব মানে? বাবু তাঁর বিছানায় শুয়ে আছেন।
অমরনাথ সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, আনাকে দেখছি না!
তিনি ঘুমোচ্ছেন। রাত জেগেছেন তো!
রাত জেগেছে? অমরনাথ চিন্তিত হলেন, কেন? খুব বাড়াবাড়ি হয়েছিল?
না। বাবুর বন্ধু হরদেববাবু এসেছিলেন। তিনি তো গেলেন তিনটের পর!
ধক করে বুকে লাগল কথাটা। হরদেব তাহলে এই বাড়িতে আসার অনুমতি পেয়েছে! শুধু আসা নয় একেবারে রাত তিনটে পর্যন্ত এমন জাগা জগতে হল যে এই সকাল নটাতেও তিনি ঘুমাচ্ছেন–অমরনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, বাবুর ঘুম ভাঙ্গেনি?
তা ভাঙ্গবে না কেন? পেচ্ছাপ পায়খানা করিয়ে চা খাইয়ে দিলাম। আমি! আনা কিছু বললে না বলতে তো চিতায় ওঠার আগে পারবো না। আমাকে একবার বাজারে যেতে হবে তাও রোগী ছেড়ে যেতে পারছি না।
কতক্ষণ লাগবে?
আধঘণ্টা। যাব। আর আসব।
ঠিক আছে, আমি তোমার বাবুর পাশে বসছি।
লোকটা তাঁকে প্রতুলবাবুর ঘরে নিয়ে এল। প্রতুলবাবু আজ বালিশ উঁচু করে মাথা রেখেছেন। চাদরের পাশ দিয়ে পা বেরিয়ে গিয়েছিল। অমরনাথ সেটা ঢেকে দিতেই প্রতুলবাবুর নজর পড়ল, ও, আপনি। আশা কোথায়? আশালতা? তাকে বড় দেখতে ইচ্ছে করে। যাওয়ার আগে মাথায় হাত বোলাবে না?
বেদম রাগ হয়ে গেল অমরনাথের। অত কাণ্ডের পরেও তিনি আশা করছেন দীপা এসে মাথায় হাত বুলিযে দেবে। ঘুণাক্ষরেও যদি জানতে পারে প্রতুলবাবু নগ্ন হয়ে একটা চাদর চাপা দিয়ে স্ব-ইচ্ছায় পড়ে থাকেন তাহলে মরে না গেলে এই ঘরে ঢুকবে না।
ছেলেমেয়োবা বড় হয়ে গেলে কিছুটা স্বাধীন তো হয়েই যায়।
স্বাধীন? স্বাধীন আবার কি? আমি টাকা না দিলে পড়তে পারত? সক, গলায় অহঙ্কাবেবাঁ ছাপ বন্ড স্পষ্ট। অমরনাথ হজম করার চেষ্টা করলেন। কথা ঘোরাবার জন্যে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ডাক্তার রোজ আসছে?
পয়সার স্বাদ পেয়েছে, না এসে পারে প্রতুলবাবু কথাগুলো বলামাত্র অমরনাথের মনে হল মানুষটা যেন আগের দিনের চেয়ে বেশী সুস্থ। এত চটপটে কথা আগের দিন বলেনি।
আমি মরছি ভেবে সবকটা শকুন উড়ে এসে বসছিল। আনা তাদের তাড়িযেছে। তার জন্যেই আমার চিস্তা! মেয়েছেলে তো।
জেনে শুনেও না জানার ভান করলেন অমরনাথ। বৃদ্ধ মালী বেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আনা কোথায়?
পাশের ঘরে। ঘুমোচ্ছে। ঘুমোক মেয়েছেলে যত ঘুমোবে তত শরীর ভরাট হবে।
প্রতুলবাবু, আনা কি কিছু বলেছে আপনাকে?
কি ব্যাপারে?
সম্পত্তি, মানে বিষযা আশয়—উইল টুইল।
না! তার কোন লোভ নেই। মুখ ফুটে কিছু চাইল না। আজ পর্যন্ত। কথা বলতে বলতে হঠাৎ নেতিযে পড়লেন প্রতুলবাবু। যেটাকে আপাতচোখে সুস্থতা বলে মনে হচ্ছিল সেটি অন্তহিঁত হল। চোখ বন্ধ করে কাঁপতে লাগলেন। কিছুক্ষণ বসে রইলেন অমরনাথ। আনা উইল সই করায়নি। সম্পত্তির জন্যে যে মেয়ের জিভ লোভে লকলক করছে তাকে প্রতুলবাবু সন্ন্যাসিনী সাজাবেন। এখন তাঁর চোখ বন্ধ। আচমকা অনর্গল কথা বলে অত্যন্ত পরিশ্রান্ত।
প্রতুলবাবু বুঝতেই পারলেন না। অমরনাথ উঠে দাঁড়িয়েছেন। লোকটি তাঁকেও শকুনের দলে ফেলেছে বোঝার পর থেকেই খুব খারাপ লাগছিল। মনে হল চুপচাপ এ বাড়ি থেকে চলে গিয়ে দীপাকে সব কথা খুলে বলে হালকা হবেন। প্ৰায় নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে এপাশ ওপাশ তাকালেন তিনি। লোকটা অবশ্য তাঁকে বিশ্বাস করে বাজার করতে গিয়েছে। কি করা যায়! পাশের ঘরের দরজা ভেজানো। আনাকে ঘুম থেকে তুলে ব্যাপারটা বলে যাবেন? মন স্থির করে দরজা ঠেলতেই সেটা খুলে গেল। বড় ঘর। মাঝখানে চওড়া পালঙ্ক। পালঙ্কের ওপর রাজেন্দ্ৰাণীর মত শুয়ে আছে আনা। চোখ বন্ধ। একটা হাত কপালের ওপর আলগোছে রাখা। বুকের কাপড় সরে যাওয়ায় চোখ ঘুরিয়ে নিলেন অমরনাথ। তিনি দরজা থেকে ডাকলেন, আনা, আনা।
দুবার ডাকতেই হাত সরাল আনা। তার ঘুম ভেঙ্গেছে। এক মুহুর্ত তাকিয়ে থাকার পর ঠোঁটে হাসি খেলল অথচ বুকের আঁচলের কথা খেয়াল করল না।
এই মুহুর্তে সে মোটেই প্রৌঢ়া নয়, গৃহপরিচারিকার ভূমিকা অন্তহিঁত। অমরনাথ গলায় শব্দ করলেন, এসেছিলাম। একটু দরকার ছিল।
ঝট করে উঠে বসে কাপড় সামলে নিল আনা, এখানেই বসুন, আমি আসছি। দরজা থেকে সরে দাঁড়াতেই আনা পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। অমরনাথ ঘরে ঢুকলেন। একটা আঁশটে গন্ধ যেন ঘরে ঝুলছে। জানলাগুলো বন্ধ। তিনি এগিয়ে গিয়ে জানলা খুললেন। রোদ এবং হাওয়া ঢুকলে পালঙ্কের দিকে তাকালেন। এমন দামী পালঙ্কে তিনি কখনও শোননি। ঘরে আরও দুটো চেয়ার আছে। তার একটিতে সতর্ক ভঙ্গীতে বসলেন তিনি। এটি তাহলে আনার ঘর। প্রতুলবাবুর ঘরের পাশেই সে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গতরাত্রে হরদেব কি এই ঘরে ছিল? হরদেবের যে বয়স, শরীর যে পরিমাণ শুকিয়েছে তাতে রাত তিনটে পর্যন্ত জেগে আনার সঙ্গে–। ছিছিছি। লোকটাকে দেখেই অবশ্য নোংরা মনে হয়। কিন্তু সে দিনরাত আনাকে যা-ইচ্ছে-তাই গালমন্দ করত। আবার আনাও ওর প্রসঙ্গ উঠলে গাল না দিয়ে ছড়িত না। অমরনাথের মনে হল দুই শয়তানের মিলন হয়েছে। এবং তার ফলে তাঁর মত ভালমানুষের পক্ষে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরী হবে। এই অবস্থায় মাথা গরম করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
আনা ঘরে ঢুকল পোশাক পরিবর্তন করে। তার মুখ চোখ পরিষ্কার। সামনে দাঁড়িয়ে বলল, কখন এসেছেন? বেলা যে এত হল টেরই পাইনি।
শরীর খারাপ বুঝি?
না। কাল রাত তিনটে পর্যন্ত জগতে হয়েছিল।
প্ৰতুলবাবু দেখলাম আগের থেকে ভাল।
তা ভাল।
উইলটার কোন খবর আছে?
হ্যাঁ। ওটা যেমনটি চেয়েছিলাম তেমনই লিখিয়েছেন।
তাহলে প্রতুলবাবুকে দিয়ে—।
করিয়েছি।
অমরনাথ চমকে উঠলেন। প্রতুলবাবু উইলে সই করেছেন? কই, তিনি তো একথা একবারও বলেননি। আনা হাসল, দুদিন আগে থেকে নানান কাগজপত্রে এমনি এমনি সই করতাম। উনি এত বিরক্ত হতেন যে শেষে দেখতেনও না কি সই করছেন।
অমরনাথ উঠে দাঁড়ালেন, তাহলে—!
কাল সব ফাঁস হয়ে গিয়েছে।
মানে?
আপনি যে উকিলকে দিয়ে ওটা লিখিয়েছেন সে কোর্টে গল্প করেছে। মুখে মুখে খবর পৌঁছেছে হরদেব ঘোষালের কানে। তারপরেই সে ছুটে এসেছিল আমার কাছে। তাকে চেপে রাখব। এমন সাধ্য নেই আমার।
তারপর?
হরদেব অবশ্য ভাল কথা বলেছে। আপনার মেয়ে তো ঘেন্নায় এর নাম মুখেও আনে না। স্বীকারই করে না বিয়ে হয়েছিল। সম্পত্তি সে ছুঁয়েও দেখবে না। তাহলে তার নামে বড় অংশ লিখিয়ে লাভ কি? সইসবুদ যখন আমিই করছি তখন পুরোটাই আমার নামে লিখিয়ে নেওয়া ভাল। হরদেব যদ্দিন বেঁচে থাকবে দেখাশোনা করবে, আমি মাসোহারা দেব। লোকটা অবশ্য শেয়াল, তবে শেয়ালের বুদ্ধিকে কাজে লাগালে সিংহের হাত থেকে বাঁচা যায়। তাছাড়া ওর নজর ছিল আমার ওপর অনেক দিনের। পায়নি বলেই শত্ৰুতা করছিল। এরকম লোককে বশ মানাতে পারলে কোন চিন্তা থাকে না। কথা শেষ করে আনা এগিয়ে গেল আলমারির দিকে। সেটি খুলে অমরনাথের দেওয়া উইলটি বের করে বলল, এটা রেখে কোন লাভ নেই।
অমরনাথ দেখলেন আনা ওটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলছে। তিনি, হতভম্ব হয়ে গেলেন। নারীর এ কি রূপ। টুকরোগুলো একটা কাগজে মুড়ে আনা বলল, ব্যস। হয়ে গেল। আর কোন চিহ্ন রইল না।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। হরদেবকে শকুন বলা হয়েছিল!
সত্যি কথা। দেখুন, আমি মেয়েছেলে। পাশের ঘরের লোকটার পা নাড়ার ক্ষমতা নেই তবু তিনি বেঁচে আছেন বলেই মাথার ওপর একটা পুরুষ আছে। পুরুষ ছাড়া মেয়েছেলে মানে আঢাকা খাবার ছাদে রাখা। উনি আপনাকে আমার দায়িত্ব নিতে বলেছিলেন। আপনি বা কাড়েননি। পঁচিশ ভাগ দিয়েই হাত মুছে নিতে চান। কোন পচিশ ভাগ। এই বাড়ির এক সিকি জমি? তা দিয়ে কি করব আমি?
তা কেন? আমি কি আপনাকে ঠকাতাম?
শুধু কথায় চিড়ে ভেজে মুখুজ্জে মশাই?
শুনেছি আপনার আত্মীয়স্বজন আছে দেশে–।
অতীত, অতীত। আমি তো অতীত হইনি। এখনও ভগবান শরীরটা রেখেছেন। শরীরে সাধ আহ্বাদ আছে। যৌবনের শুরুতে ওই পাশের ঘরের উনি যে জ্বালা তৈরী করে দিয়েছিলেন তা যে করে মিটবে কে জানে! আনা হাসল, তা বলে আপনার সঙ্গে আমার কোন শত্ৰুতা নেই। আপনি কুটুম মানুষ, যখন খুশী তখন আসবেন। এতদিন ছাদ ছিল মাথাব ওপর এখন ছাতি বেছে নিলাম। সুবিধে হল এই ছাতির বাঁট আমার হাতেই ধরা থাকবে।
তাহলে সব সম্পত্তি নিজের নামে করে নেওয়া হল?
উপায় কি? আনা হাসল।
অমরনাথ উঠে দাঁড়ালেন। কেমন যেন অসহায় লাগছে নিজেকে। হঠাৎ তিনি প্রশ্নটা করলেন, তা এর জন্যে এত জল ঘোলা হল কেন? আমাকে না ডেকে প্রথম দিকেই তো নিজের নামে করে নেওয়া যেত।
বললাম যে, মেয়েমানুষের মন। আপনার মেয়েকে পুরো ঠেকাতে ইচ্ছে ছিল না। জানলে তিনিও সই করতেন না। এখনও আশালতা করে যাচ্ছেন। কিন্তু যেই বুঝতে পারলাম। আপনার মেয়ে নখ দিয়েও এ বাড়ির বিষয় ছোবে না। তখন আর মনে হল না। ঠকাচ্ছি। পাঁচভূতের পেটে না গিয়ে আমিই ভোগ করি। আনা ঘুরে দাঁড়াল, কি খাবেন বলুন, চা না সরবৎ?
কিছু না। যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালেন অমরনাথ।
আর একটা কথা। আনা মৃদুস্বরে বলল। অমরনাথ থেমে গেলেন।
হরদেব আর আপনার মধ্যে পছন্দ করতে গেলে আমার মন প্রথম জনকে কখনই মেনে নিতে পারে না। তাই অপেক্ষা করছিলাম। তাই রাজী করেছিলাম ভাগ করে নিতে। এখন বুঝে গেছি গাছের পাখির থেকে হাতের পাখি ঢের ভাল।
অমরনাথ হন হন করে বেরিয়ে এলেন। নিজেকে খুব ক্ষুদ্র লাগছিল তাঁর। এবং সেই সঙ্গে কিঞ্চিৎ অসহায়। কোন নারী, সে দাসী অথবা মহারাণীই হোক তাঁকে কামনা করে হতাশ হয়ে এমন কাণ্ড করবে তা কখনও চিন্তায় ছিল না। যা হোক, খুব বড় ফাঁড়া কেটে গেল মনে করতে গিয়ে আর এক ধরনের হতাশ বোধ তাঁকে আচ্ছন্ন করছিল। এত বড় সম্পত্তি একেবারে হাতছাড়া হয়ে গেল?
গেটের কাছে পৌঁছেই শক্ত হলেন অমরনাথ। চুপিসানো মুখে হাসতে হাসতে হরদেব ঘোষাল আসছে। দুটো হাত মাথার ওপরে ঠেকিয়ে হরদেব বলল, নমস্কার অমরনাথবাবু, ধন্য আপনি। অমন আদর্শবতী কন্যার পিতা সবাই হতে পারে না।
মানে? অমরনাথ ফিস ফিস করলেন।
এক কথায় বলে দিল প্রতুলের সম্পত্তি সে ছুঁয়েও দেখবে না।
আপনার সঙ্গে করে কথা হল? গতকাল। মাঝখানে একবার হোস্টেলে যেতে বলেছিল। আমি যাইনি। কি দরকার! আপনিও নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু আনু যখন বলল আমাকে তার প্রয়োজন তখন দেখা করতে গেলাম। সব বললাম।
বললেন?
হ্যাঁ। আমি মিথ্যাচার করতে পারব না। তবে ওই ব্যাঙ্কের টাকার কথা বলিনি। তা সে বলল প্রতুল। যদি লিখেও দেয়। তবুও নেবে না। আমার কাজ হয়ে গেল। কাল রাত্রে দুজনে বসে সব ঠিক করে নিয়েছি। আজ প্রতুল সই করযে, আমি সাক্ষী হব। তারপরেই সমস্ত সম্পত্তি আনুর নামে কোর্টে আইনসম্মত করিয়ে নেব। এটা ঠিক, আনু যা করেছে সব তো তারই পাওনা হরদেব হাসলেন।
আনু?
আনা। প্রতুল তো আদর করে আনু ডাকত। বুনো বেড়াল।
আর তখনই দূরে বাড়ির ভেতর থেকে উচ্চস্বরে কান্না ভেসে এল। হরদেব চমকে উঠল, আনুর গলা! কি হল? প্রতুল টেসে গেল? সর্বনাশ। উইল তো এখনও সই কাবানো হয়নি। পড়ি কি মারি করে হরদেব ছুটল বাড়ির দিকে। অমরনাথ আর যেতে পারলেন না। বুক থেকে না উঠলে এমন কান্না মানুষ কাঁদতে পারে না....
হিত্তি গেনু, হুত্তি গেনু, গেনু জলপাইগুড়ি/ জলও নাই, গুড়িও নাই পাইতে সুড়সুড়ি/ নিজের চোখুত দেখি আসিনু শহরটার ঢক/ নামের বাহার অফুলা শাক, মানষিলায় ঠক।
বিষণ্ণ চেহারার একটি মানুষ একতারা বাজিয়ে গান গাইছিল কিং সাহেবের খাটে বসে। সামনের। বালির চরে পন্থীরাজ ট্যাক্সিগুলো জিরোচ্ছে। এ পাশে করলা আর তিস্তার মিলনমুখে কিছু দোকান, চা সিঙ্গাডার আর ঘাটবাবুদের। এখন ভরদুপুর। কলেজ থেকে জনা চারেক মেয়ে আচমকা ছুটি হওয়ায় তিস্তা দেখতে এসেছিল চুপিসারে। আর এসেই ওরা ওই গানটা শুনল।
জলপাইগুড়ি জেলার মানুষের বাংলা কলকাতার থেকে আলাদা। তা কোন জেলাব ভাষাই বা ঠিকঠাক মিলে যায় কলকাতার সঙ্গে? এতদিন চালু ছিল কামরূপী। আর বঙ্গলা—বরেন্দ্রী মিশ্রিত এক ধরনের বাবু বাংলা। কামরুপী বলেন রাজবংশী এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ। দেশ বিভাগের পর এই বারো বছরে ব্যাপারটা ওলট পালট হয়ে যাওয়ার মুখে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষেরা বিশেষ করে বগুড়া, রাজশাহী, পাবনা আর মৈমনসিংহ থেকে আগত শরণার্থীরা জলপাইগুড়ি শহরের প্রান্তে পত্তন করলেন উদ্বাস্তু কলোনির। মাসকলাইবাড়ি বা পাণ্ডাপাড়ায়, সেই কলোনি সীমাবদ্ধ থাকল না, সস্তা চাষের জমি এবং বসতজমি পাওয়ায় তাঁরা ছড়িয়ে পড়লেন ড়ুয়ার্সের গ্রামে গ্রামে, অরণ্যে। এবার কামরুপী এবং বঙ্গালী-বারেন্দ্রীর সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের ওইসব জেলার ভাষা যা কিনা প্ৰত্যেকেরই প্ৰায় আলাদা চেহারা, মিলে মিশে একটা বাংলা ভাষা চালু করতে চাইছে যার ক্রিয়া পদে পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব, শব্দভাণ্ডারে কামরূপী ভাষার প্রচুর অস্তিত্ব এবং পরিবেশনে কলকাতার বাবু বাংলার ছায়া স্পষ্ট। মাত্ৰ বারো বছরেই এই কাণ্ড। জলপাইগুড়ি আনন্দচন্দ্ৰ কলেজের অধ্যাপক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বলতেন, আমরা একটা চমৎকার ভাষা পেলাম কারণ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষরা বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছেন। যদি ওঁরা সবাই একই জেলা থেকে এখানে আসতেন তাহলে এ জেলার ভাষার অর্ধেকটাই হয়ে যেত। রাজসাহী বা মৈমনসিংহের।
অথচ চা-বাগানে দীপারা যে বাংলা বলত তাতে পূর্ববাংলার ভাষা যেমন ছিল না তেমনি কামরূপী ভাষার প্রভাবও পড়েনি। যেহেতু মুষ্টিমেয় কয়েকটি পরবারের বাস ছিল সেখানে এবং বহিরাগত মানুষও গল্প-উপন্যাসের চরিত্রের ভাষায় কথা বলতেন তাই দীপাদের বিপাকে পড়তে হয়নি। বরং মদেশিয়া অনেক শব্দ কথার মধ্যে ঢুকছিল। ঠাকুমা প্রায়ই সতর্ক করতেন শব্দ-উচ্চারণে গোলমাল হলে। অমরনাথ তো বাঙাল শব্দ শুনলেই রোগে যেতেন। অন্তত পরবারের মানুষের মুখে। হোস্টেলে এসে দীপা নিজের অজান্তে নতুন বাংলা বলতে লাগল সঙ্গিনীদের সংস্পর্শে। এখনও তাদের কলেজে শরণার্থী ছেলেমেয়েরা ভর্তি হয়নি, স্বাধীনতার আগে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে একধরনের বিনীতভাব ছিল, নতুন পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতেন তাঁরা, বেপরোয়াভাবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ছিল না। যেসব তরুণ পূর্ববাংলায় স্কুল শেষ করে এখানকার কলেজে দেশ বিভাগের পর ভর্তি হয়েছিল তাদেরও সম্ভবত নতুন পরিবেশে ভাষার জন্যে একধরনের সঙ্কোচ হত। এখন দীপাদের ক্লাসে যে কটি মেয়ে রয়েছে তাদের কেউ শরণার্থী নয়। অথাৎ এখনও সেই প্রজন্মের কলেজে পড়া শুরু হয়নি।
মানুষটি রাজবংশী। তাঁর ভাষা কামরূপী। দুই একটি শব্দ কানে প্ৰথমে অবোধ্য ঠেকলেও কয়েকবার উচ্চারিত হবার পর সহজ হল। দীপার সঙ্গিনীদের ওর গান শোনার চেয়ে কিং সাহেবের ঘাট দেখার দিকেই কৌতূহল বেশী। কিন্তু দীপাকে লোকটা টানছিল। গান শেষ হলে কাঁঠালগাছের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা চোখ মেলে মেয়েদের দেখল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে নিল। মানুষটির বয়স হয়েছে কারণ দাড়িতে রুপোর ঝিলিক। দীপা তার এক নতুন বান্ধবাঁ সরমাকে বলল, লোকটার সঙ্গে কথা বলব। আমার সঙ্গে যাবি?
সরমা সহজ মেয়ে। জলপাইগুড়ি শহরের সবরকম সংস্কার নিয়ে মানুষ। প্রিয় গায়কের দিকে তাকিয়ে সে ইতস্তত করল। দীপা বলল, নতুন স্যার বলছিলেন না যে দরবেশ বাউল ফকিরদের গানে সাধারণ মানুষের কথা ফুটে ওঠে। আমার ওঁর গান শুনে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছে কেন উনি জলপাইগুড়ির মানুষদের ঠিক বললেন।
কিছু যদি মনে করে? সরমা বলল।
কি মনে করবে? আমাদের চেয়ে অনেক বড়। প্ৰায় বাবার মত।
লোকটা কিন্তু ফকির না।
কি করে বুঝলি।
ফকিরদের এরকম পোশাক থাকে।
নতুন স্যার বলেছেন দেশজ গান থেকে অনেক প্রবাদ পাওয়া যায়। কয়েকটা পেয়ে গেলে কেমন হয় বলতো? চল না!
আনন্দচন্দ্র কলেজে সম্প্রতি যোগ দেওয়া এক অধ্যাপক বেশ আলোড়ন তুলেছেন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। তিনি শুধু যত্ন করেই পড়ান না, সাহিত্যের নানান খবর গল্প করে বলেন। ছেলেরা সম্ভবত নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের পর আর একজনকে বন্ধুর মত পেয়েছে। তাঁর নামে কাজ হল। সরমা এগোল। অন্য দুজন দূর থেকে দেখতে লাগল।
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দীপা জিজ্ঞাসা করল, এই গানটা আপনি বানিয়েছেন?
মানুষটি মৃদু মাথা নাড়ল। তার দাড়ি বাতাসে উড়ছিল, সেই ক্ষমতা কি দীনদয়াল আমাকে দিয়েছেন? আমি কুড়িয়ে কুড়িয়ে জমা করি বুকের মধ্যে। যখন ইচ্ছে হয় তখন গাই মা। এই গান কি তোমাদের ভাল লেগেছে?
হ্যাঁ। আপনি জলপাইগুড়ির মানুষদের ঠিক বললেন কেন?
মানুষ যদি ঠকায় তাহলে তাকে ঠক বলতেই হয়।
আপনি গানের সময় ওই ভাষায় গাইলেন, কথা বলছেন শুদ্ধ বাংলায়।
তোমরা তো বাবুদের বাড়ির মেয়ে। তাই তোমাদের বুঝতে সুবিধে হবে বলে বলছি। আর আমার ঘর ছিল নদীয়া জেলায়। ভাসতে ভাসতে অনেককাল এখানে ঠেকে আছি।
আপনি এরকম গান অনেক জানেন?
না মা। আমার পুঁজি অল্প। তবে এর প্রেমে পড়ে আছি। যা পাই তাই নিই। বাদ বিচার করি না। ত্রিস্সায় না জানে ঘাট কি আঘাট/ নিমদে না জানে ভাঙ্গা ঘাট/ পিরীত না বুঝে জাত কি অজাত। সুর করে নিচু গলায় গাইল লোকটা।
দীপা চটপট হাতের খাতা খুলল, আর একবার বলবেন?
কেন? লিখে রাখব। না মা, আমি লিখে রেখেছি মনে আর তুমি লিখবে খাতায়? সেটা কি মানানসই হল? মনে রাখতে পারলে রাখো। যদি থাকে মনত, হয়না ক্যানে দেশের কোনত, পিরীতি যদি মাচায় থাকে, দূর হলেই কি ভুলে তাকে?
আপনার মত স্মরণশক্তি নেই যে আমার।
কি করে বুঝলে? লোকে সুখের কথা ভুলে যায়, দুঃখের কথা ভুলতে পারে না। তুমি বাচ্চা মেয়ে। বুঝবে না এখন। কখনও যদি দুঃখের মত দুঃখ পাও দেখবে চেষ্টা করলেও ভুলতে পারবে না।
দীপার মুখ থমথমে হয়ে গেল। এ কথাটা কতখানি সত্যি তা সে জানে। সব কিছু ভোলা যায়। কিন্তু সেই ফুলশয্যার রাত্রের নরকটাকে কিছুতেই ভুলতে পারে না সে।
কিন্তু আপনি এখনও স্পষ্ট বললেন না কেন শহরের লোক ঠক?
লোকটা হাসল। তানপুরায় শব্দ করে মুখে বলল, ফুটানির রামা/ উপর ধুতি তলে জামা।
সরমা আর দীপা একসঙ্গে হেসে উঠল। দীপা সরমাকে বলল, এটা আমি কখনও ভুলব না। আপনি এরকম আর কয়েকটা বলুন না।
শহরের লোক বড় অহঙ্কারী। নিজের গুণ পাঁচমুখে বলে। এরা সব রাজার ঘরের বান্দী। কিন্তু, ছান ফ্যালাইতে দেখা যায় খোলা মাথায় চান্দি। লোকটা এবার হাসল, আচ্ছা! লিখে নাও তিনটে উপদেশ। আমার কথা না, এই জেলার মানুষেধ। পূর্ব-পুরুষদের মুখ থেকে শুনে শুনে মনে রেখেছে। কিন্তু মনেই রেখেছে কাজে তো করা যায় না। করতে চাইলেও না। লেখ। লোকটা চোখ বন্ধ করল। কিন্তু দীপা খাতা খুলল না। সরমা তাকে খোঁচা দিল। দিয়ে নিজের খাতা খুলল। লোকটি চোখ বন্ধ করে বলল, সুদিনের বাপ ভাই, নিদান কালে কহয় নাই। সুজনেরও ড়ুবে নাও হাতিরও পিছলে পাও। নয়া নয়া বথুয়া শাক নুন তেলে খায়, বুড়া হইলে বথুয়া শাক গড়াগড়ি যায়। ব্যাস। হয়ে গেল। এবার আমি চলি। কোন ভূমিকা না করেই লোকটা খেয়াঘাটের দিকে পা বাড়াল। ওরা দেখতে পেল খেয়াঘাটের সামনে পৌঁছানো মাত্র মাঝিরা লোকটিকে সাদরে নৌকোয় তুলে নিল। এক নৌকো মানুষ কিং সাহেবের ঘাট ছেড়ে রওনা হল বার্নিশ ঘাটের দিকে। হঠাৎ দীপার বুক টনটন করতে লাগল। ওর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। চা-বাগানে যেতে। এই পথ দিয়ে এক অপরাহুে সে এক অসুস্থ শরীরে চা-বাগানে গিয়েছিল। এখন তো সব চেনা। শনিবারে চলে গিয়ে সোমবার সকালে ফিরে আসা যায়। হাতখরচের পয়সা বাঁচিয়ে গাড়িভাড়া দেওয়া যায়। তবু অনেকদিন যাওয়া হয়নি। সেই পুজোর ছুটির আগে যাওয়ার কথাও নয়।
কোর্টের পাশ দিয়ে নেতাজী পুলের দিকে আসছিল ওরা। হঠাৎ কেউ একজন চিৎকার করতে লাগল, আশা মা, আশালতা মা। একটু দাঁড়াও।
দীপা প্রথমে খেয়ালই করেনি। ওর বন্ধুদের কারো ওই নাম নয়। কিন্তু কোর্টের প্রাঙ্গণ থেকে হস্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসা লোকটিকে দেখতে পেল সারমা। পেয়ে বলল, এই আমাদের থামতে বলছে। ওরা দাঁড়াল। হরদেব ঘোষাল ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে আসছে। দীপা তাকে চিনতে পারল। পেয়েই শক্ত হয়ে গেল।
হরদেব ততক্ষণে সামনে এসে পড়েছেন, এই যে আশা মা, দূর থেকে একঝলক দেখেই চিনতে পেরেছি। এদিকে কোথায় এসেছিলে? কোর্টে?
আপনি ভুল করছেন। আমার নাম দীপাবলী।
তা তো জানি। কিন্তু আমাদের পক্ষে বউমা তোমার নাম রেখেছিলেন। আশালতা। ভারি মিষ্টি নাম। তা তোমার বাবার খবর কি?
দীপা কি বলবে বুঝতে পারছিল না। বন্ধুরা, কলেজ এবং হোস্টেলের কেউ জানে না তার বিয়ে হয়েছিল। জানাবার সুযোগই হয়নি। সে বিধবা একথা বলার প্রয়োজনই বোধ করেনি। বন্ধুদের সে চেনে। সে বিবাহিতা এই খবর ওরা মেনে নিতে পারবে। কিন্তু যদি জানে বিধবা তাহলেই প্রতিক্রিয়া হবে। হিন্দু-বিধবা মেয়ে মাছ-মাংস খাচ্ছে, রঙিন শাড়ি পরছে, ছেলেদের সঙ্গে কথাবার্তা বলত, এটা হজম করা ওদের পক্ষে মুশকিল হয়ে পড়বে। সে বুঝতে পারছিল হরদেবের সঙ্গে তর্ক করলে সেই তথ্যটা এরা জেনে ফেলবে। অতএর মুখ ফিরিয়ে দীপা বলল, ভাল আছেন।
তা তো থাকবেনই। আমি তোমাকে কোর্টের দিকে দেখে ভাবলাম তুমি বুঝি উইল রেজিষ্টি করতে এসেছি। আচ্ছা মা, তুমিই বল, ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খেতে হয়?
আপনি কি বলছেন আমি বুঝতে পারছি না। কিসের উইল?
তুমি জানো না কি করে একথা বিশ্বাস করি বল?
দেখুন, আমাদের হোস্টেলের নিয়ম রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোন ছেলের সঙ্গে কথা বলা চলবে না। জানতে পারলে হোস্টেল থেকে বের করে দেবে। আপনি বরং আমাদের হোস্টেলের গেস্টরুমে এসে আমার সঙ্গে কথা বলবেন। করে আসবেন বলুন? দীপা এ ছাড়া কিছুই বলতে পারল না।
কবে আবার? আজই আসতে পারি। ঠিক আছে, তুমি এগোও, আমি আসছি। ঠিক কথা, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলা ঠিক নয়। হরদেব হাসল।
দ্রুত পা চালাল দীপা। বন্ধুরা কয়েক পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হরদেবের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব তৈরী হবার পর সরমা জিজ্ঞাসা করল, কে রে?
আমার বাবার পরিচিত।
ওসব কি বলছিল?
কিসব? দীপা নিজেই যেটা বোঝেনি সেটা সরমারা কতখানি বুঝছে জানতে চাইল।
ওই উইল টুইল। লোকটা যেন কেমন!
আর এক বন্ধু বলল, আমরা জানতামই না তোমার নাম আশালতা!
ধ্যাত। যত বাজে কথা।
ওমা, ওই লোকটা তোমাকে আশা আশালতা বলে ড়াকছিল। নাম না হলে কেউ মিছিমিছি। ডাকে। বলল না, আমাদের পক্ষে বউমা তোমার নাম রেখেছিল।
চতুর্থ জন বলল, আমাদের পক্ষে মানে? এসব তো বিয়ের ব্যাপারে বলে।
সরমা বলল, আমার মায়ের নাম আগে ছিল গোলাপ বিয়ের পাব ঠাকুমা রাখেন সুধা। বিয়ের পর হরদম নাম পাল্টে যেত। তোমার কি বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল?
মুখ গম্ভীর করে হাঁটছিল দীপা। এই সময় সত্যি কথাটা বলে দেবে ওদের? কাল সকালের মধ্যে খবরটা ছড়িয়ে যাবে চারপাশে। কিন্তু মিথ্যে কথা বললে সেটা যদি ফাঁস হয়ে যায়? এতদিন কেউ জিজ্ঞাসা করেনি বলে সে আগ বাড়িয়ে কিছু বলেনি। সেটা ছিল একরকম। এখন গলা ফুলিয়ে মিথ্যে বললে তো ধরা পড়লে আরও লজ্জা। সে মাথা নেড়ে বলল, হয়েছিল।
তারপর?
ছেলেটা অসুস্থ ছিল, মরে গিয়েছে। এটা সত্যি তবু কোথাও তো রাখা ঢাকা থাকল। দীপার কথা শেষ হওয়ামাত্র সরমা বলল, বাঁচা গেছে।
হরদেব কিন্তু এল না। দুদিন অপেক্ষা করে দীপা চা-বাগানে চিঠি দিল ঘটনার বর্ণনা দিয়ে। অমরনাথের কাছে জানতে চাইল ব্যাপারটা কি? অমরনাথ। এতদিন ঘটনার তিপ্রকৃতি বিশদভাবে অঞ্জলিকে বলেননি। মনোরমার কিছু জানা নেই। মেয়ের চিঠি পেয়ে অমরনাথ বুঝলেন আর চেপে রাখা যাবে না। কিন্তু এখন বলতে গেলে ওরা জানতে চাইবে ঘটনাটা কেন বলেনি আগে। অবশ্য অঞ্জলি প্রতুলবাবুর দেওয়া টাকাটার কথা জানে। অর্ধেক বলা আছে যাকে তাকেই তিনি বাকি ঘটনাটা রেখে ঢেকে বললেন।
অঞ্জলি স্বামীর দিকে তাকালেন, এসব কথা তুমি আগে বলনি কেন?
আমি অপেক্ষা করছিলাম। আসলে না আঁচালে তো বিশ্বাস নেই।
তার সঙ্গে আমাকে না বলার কি আছে! আমি তোমাকে ঠিক বুঝতে পারছি না। সত্যি ব্যাপারটা খুলে বল। অঞ্জলি সন্দিগ্ধ গলায় বলল।
যা বললাম। তাই সত্যি! আসলে আমার মনে হচ্ছিল এই যে সম্পত্তির জন্যে যাওয়া আসা করছি, এসব শুনলে তুমি আমাকে খুব লোভী ভাববে। একথা ঠিক, মেয়ে বিধবা হবার পর আমরা সম্পর্ক রাখিনি কিছুদিন। ওরা যেভাবে লুকিয়ে বিয়ে দিয়ে মেয়ের সর্বনাশ করেছে তাতে মুখদর্শন করাত পাপ। তোমার মেয়েরও তাই ধারণা। কিন্তু সব পাপের তো একটা প্ৰায়শ্চিত্ত করার নিয়ম আছে। প্রতুলবাবু যদি সম্পত্তি তার বউমাকে দিতে চান তাহলে চাইতে পারেন। নেওয়া না নেওয়া আমাদের ইচ্ছে। কিন্তু চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার কোন মানে হয়? দীপা ওই সম্পত্তির ন্যায্য উত্তরাধিকারী। তাকে সম্পত্তি পাইয়ে দিয়ে আমি কি কোন অন্যায় করছি?
তোমার মেয়ে যদি না নেয়?
না নিলে কাউকে দান করে দেবে। তাহলে অন্তত বারোভূতে লুটেপুটে খাবে না?
কত টাকার সম্পত্তি?
লক্ষ লক্ষ টাকা!
অঞ্জলি উত্তরটা শুনে চুপ মেরে গেল। অমরনাথ বললেন, আমার কি! মেয়ে যদি ভোগ করতে চায় করবে না। চাইলে ছেড়ে দেবে। আমি তো আর ভাগ বসাতে যাচ্ছি না। কিন্তু এই হরদেব লোকটা এসব বলতে গেল কেন? উইলের কথা তো আমি তাকে বলিনি।
লোকটা কেমন?
খুব খারাপ। প্রতুলবাবুর সেই টাকা থেকে কমিশন নিয়েছে। আনার ওপর নজর ছিল।
আনা! প্রতুলবাবুর সেই ঝি যে দীপাকে সাহায্য করেছিল?
হ্যাঁ। সেই তো এখন সমস্ত কিছু দেখাশোনা করছে। প্রতুলবাবুর পাশে সে একা আছে। আনা যা চাইবে তাই হবে।
আনা কি চায়?
সম্পত্তির ভাগ। আমাকে বলল একটা উইল করে নিয়ে যেতে। করলাম। তা পরীক্ষা না করিয়ে সই করাবেন না। তিনি প্রতুলবাবুকে দিয়ে।
সরাসরি প্রতুলবাবুর সঙ্গে কথা বলছি না কেন?
তিনি তোমার মেয়েকে দেখতে চান।
ঠিক আছে, এবার যখন তুমি জলপাইগুড়িতে যাবে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেও। আমি দীপাকে বুঝিয়ে বলব। আর হ্যাঁ, ওই আনার কাছে তোমার এক যাওয়ার দরকার নেই।
অমরনাথ স্ত্রীর দিকে তাকালেন, জঙ্গলের অন্ধকারে শহরের বিদুষী সুন্দরীকে সাইকেলের পেছনে বসিয়ে এনেছি চরিত্র মুঠোয় করে ধরে, তাতেও তোমার বিশ্বাস হল না?
অঞ্জলি মাথা নাড়ল, পুরুষমানুষের আবার চরিত্ৰ! বাজে বকো না তো। খুঁটি বাঁধা বকনা। খুঁটি উঠে গেলে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
কিন্তু এ যাত্রায় অমরনাথ স্ত্রীকে নিয়ে এলেন না। হরদেবের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হবে। সেইসময় স্ত্রীলোক সঙ্গে থাকলে বিপত্তি হবে। দীপার ছুটির সময় হয়ে এসেছে। বড়দি যদি অনুমতি দেন তাহলে তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছে অঞ্জলি।
কিং সাহেবের ঘাটে নেমে কোর্টের দিকে পা না বাড়িয়ে অন্য রাস্তা ধরলেন তিনি। তিস্তার গায়ে বাঁধ বাঁধা হচ্ছে। ভয়ঙ্করীকে সরকার এবাবে বেধে ফেলবে। ওপাশে নদীর ওপর ব্রিজ হয়ে গেলে ড়ুয়ার্স এক দৌড়ে কাছে এসে যাবে। ট্রেন চলবে বাস চলবে। আর ওই নৌকো আর পাখীরাজ টাক্সিগুলো উধাও হয়ে যাবে। কাজকর্ম দেখে মনে হচ্ছে। আর বেশী দিন নেই। নির্জনে পথ চলে অমরনাথ চলে এলেন হাকিমপাড়ায়।
প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে ঢুকে সদরে না গিয়ে বাগানের পথ ধরে পেছনে এসে গলা খুললেন তিনি, কেউ আছেন?
সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়িঙ্গে গোছের এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এল, অ! আপনি।
এই লোকটিকে বাগানে কাজ করতে দেখেছিলেন অমরনাথ একসময়। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার। আর সব কোথায়?
আর সব মানে? বাবু তাঁর বিছানায় শুয়ে আছেন।
অমরনাথ সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, আনাকে দেখছি না!
তিনি ঘুমোচ্ছেন। রাত জেগেছেন তো!
রাত জেগেছে? অমরনাথ চিন্তিত হলেন, কেন? খুব বাড়াবাড়ি হয়েছিল?
না। বাবুর বন্ধু হরদেববাবু এসেছিলেন। তিনি তো গেলেন তিনটের পর!
ধক করে বুকে লাগল কথাটা। হরদেব তাহলে এই বাড়িতে আসার অনুমতি পেয়েছে! শুধু আসা নয় একেবারে রাত তিনটে পর্যন্ত এমন জাগা জগতে হল যে এই সকাল নটাতেও তিনি ঘুমাচ্ছেন–অমরনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, বাবুর ঘুম ভাঙ্গেনি?
তা ভাঙ্গবে না কেন? পেচ্ছাপ পায়খানা করিয়ে চা খাইয়ে দিলাম। আমি! আনা কিছু বললে না বলতে তো চিতায় ওঠার আগে পারবো না। আমাকে একবার বাজারে যেতে হবে তাও রোগী ছেড়ে যেতে পারছি না।
কতক্ষণ লাগবে?
আধঘণ্টা। যাব। আর আসব।
ঠিক আছে, আমি তোমার বাবুর পাশে বসছি।
লোকটা তাঁকে প্রতুলবাবুর ঘরে নিয়ে এল। প্রতুলবাবু আজ বালিশ উঁচু করে মাথা রেখেছেন। চাদরের পাশ দিয়ে পা বেরিয়ে গিয়েছিল। অমরনাথ সেটা ঢেকে দিতেই প্রতুলবাবুর নজর পড়ল, ও, আপনি। আশা কোথায়? আশালতা? তাকে বড় দেখতে ইচ্ছে করে। যাওয়ার আগে মাথায় হাত বোলাবে না?
বেদম রাগ হয়ে গেল অমরনাথের। অত কাণ্ডের পরেও তিনি আশা করছেন দীপা এসে মাথায় হাত বুলিযে দেবে। ঘুণাক্ষরেও যদি জানতে পারে প্রতুলবাবু নগ্ন হয়ে একটা চাদর চাপা দিয়ে স্ব-ইচ্ছায় পড়ে থাকেন তাহলে মরে না গেলে এই ঘরে ঢুকবে না।
ছেলেমেয়োবা বড় হয়ে গেলে কিছুটা স্বাধীন তো হয়েই যায়।
স্বাধীন? স্বাধীন আবার কি? আমি টাকা না দিলে পড়তে পারত? সক, গলায় অহঙ্কাবেবাঁ ছাপ বন্ড স্পষ্ট। অমরনাথ হজম করার চেষ্টা করলেন। কথা ঘোরাবার জন্যে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ডাক্তার রোজ আসছে?
পয়সার স্বাদ পেয়েছে, না এসে পারে প্রতুলবাবু কথাগুলো বলামাত্র অমরনাথের মনে হল মানুষটা যেন আগের দিনের চেয়ে বেশী সুস্থ। এত চটপটে কথা আগের দিন বলেনি।
আমি মরছি ভেবে সবকটা শকুন উড়ে এসে বসছিল। আনা তাদের তাড়িযেছে। তার জন্যেই আমার চিস্তা! মেয়েছেলে তো।
জেনে শুনেও না জানার ভান করলেন অমরনাথ। বৃদ্ধ মালী বেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আনা কোথায়?
পাশের ঘরে। ঘুমোচ্ছে। ঘুমোক মেয়েছেলে যত ঘুমোবে তত শরীর ভরাট হবে।
প্রতুলবাবু, আনা কি কিছু বলেছে আপনাকে?
কি ব্যাপারে?
সম্পত্তি, মানে বিষযা আশয়—উইল টুইল।
না! তার কোন লোভ নেই। মুখ ফুটে কিছু চাইল না। আজ পর্যন্ত। কথা বলতে বলতে হঠাৎ নেতিযে পড়লেন প্রতুলবাবু। যেটাকে আপাতচোখে সুস্থতা বলে মনে হচ্ছিল সেটি অন্তহিঁত হল। চোখ বন্ধ করে কাঁপতে লাগলেন। কিছুক্ষণ বসে রইলেন অমরনাথ। আনা উইল সই করায়নি। সম্পত্তির জন্যে যে মেয়ের জিভ লোভে লকলক করছে তাকে প্রতুলবাবু সন্ন্যাসিনী সাজাবেন। এখন তাঁর চোখ বন্ধ। আচমকা অনর্গল কথা বলে অত্যন্ত পরিশ্রান্ত।
প্রতুলবাবু বুঝতেই পারলেন না। অমরনাথ উঠে দাঁড়িয়েছেন। লোকটি তাঁকেও শকুনের দলে ফেলেছে বোঝার পর থেকেই খুব খারাপ লাগছিল। মনে হল চুপচাপ এ বাড়ি থেকে চলে গিয়ে দীপাকে সব কথা খুলে বলে হালকা হবেন। প্ৰায় নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে এপাশ ওপাশ তাকালেন তিনি। লোকটা অবশ্য তাঁকে বিশ্বাস করে বাজার করতে গিয়েছে। কি করা যায়! পাশের ঘরের দরজা ভেজানো। আনাকে ঘুম থেকে তুলে ব্যাপারটা বলে যাবেন? মন স্থির করে দরজা ঠেলতেই সেটা খুলে গেল। বড় ঘর। মাঝখানে চওড়া পালঙ্ক। পালঙ্কের ওপর রাজেন্দ্ৰাণীর মত শুয়ে আছে আনা। চোখ বন্ধ। একটা হাত কপালের ওপর আলগোছে রাখা। বুকের কাপড় সরে যাওয়ায় চোখ ঘুরিয়ে নিলেন অমরনাথ। তিনি দরজা থেকে ডাকলেন, আনা, আনা।
দুবার ডাকতেই হাত সরাল আনা। তার ঘুম ভেঙ্গেছে। এক মুহুর্ত তাকিয়ে থাকার পর ঠোঁটে হাসি খেলল অথচ বুকের আঁচলের কথা খেয়াল করল না।
এই মুহুর্তে সে মোটেই প্রৌঢ়া নয়, গৃহপরিচারিকার ভূমিকা অন্তহিঁত। অমরনাথ গলায় শব্দ করলেন, এসেছিলাম। একটু দরকার ছিল।
ঝট করে উঠে বসে কাপড় সামলে নিল আনা, এখানেই বসুন, আমি আসছি। দরজা থেকে সরে দাঁড়াতেই আনা পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। অমরনাথ ঘরে ঢুকলেন। একটা আঁশটে গন্ধ যেন ঘরে ঝুলছে। জানলাগুলো বন্ধ। তিনি এগিয়ে গিয়ে জানলা খুললেন। রোদ এবং হাওয়া ঢুকলে পালঙ্কের দিকে তাকালেন। এমন দামী পালঙ্কে তিনি কখনও শোননি। ঘরে আরও দুটো চেয়ার আছে। তার একটিতে সতর্ক ভঙ্গীতে বসলেন তিনি। এটি তাহলে আনার ঘর। প্রতুলবাবুর ঘরের পাশেই সে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গতরাত্রে হরদেব কি এই ঘরে ছিল? হরদেবের যে বয়স, শরীর যে পরিমাণ শুকিয়েছে তাতে রাত তিনটে পর্যন্ত জেগে আনার সঙ্গে–। ছিছিছি। লোকটাকে দেখেই অবশ্য নোংরা মনে হয়। কিন্তু সে দিনরাত আনাকে যা-ইচ্ছে-তাই গালমন্দ করত। আবার আনাও ওর প্রসঙ্গ উঠলে গাল না দিয়ে ছড়িত না। অমরনাথের মনে হল দুই শয়তানের মিলন হয়েছে। এবং তার ফলে তাঁর মত ভালমানুষের পক্ষে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরী হবে। এই অবস্থায় মাথা গরম করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
আনা ঘরে ঢুকল পোশাক পরিবর্তন করে। তার মুখ চোখ পরিষ্কার। সামনে দাঁড়িয়ে বলল, কখন এসেছেন? বেলা যে এত হল টেরই পাইনি।
শরীর খারাপ বুঝি?
না। কাল রাত তিনটে পর্যন্ত জগতে হয়েছিল।
প্ৰতুলবাবু দেখলাম আগের থেকে ভাল।
তা ভাল।
উইলটার কোন খবর আছে?
হ্যাঁ। ওটা যেমনটি চেয়েছিলাম তেমনই লিখিয়েছেন।
তাহলে প্রতুলবাবুকে দিয়ে—।
করিয়েছি।
অমরনাথ চমকে উঠলেন। প্রতুলবাবু উইলে সই করেছেন? কই, তিনি তো একথা একবারও বলেননি। আনা হাসল, দুদিন আগে থেকে নানান কাগজপত্রে এমনি এমনি সই করতাম। উনি এত বিরক্ত হতেন যে শেষে দেখতেনও না কি সই করছেন।
অমরনাথ উঠে দাঁড়ালেন, তাহলে—!
কাল সব ফাঁস হয়ে গিয়েছে।
মানে?
আপনি যে উকিলকে দিয়ে ওটা লিখিয়েছেন সে কোর্টে গল্প করেছে। মুখে মুখে খবর পৌঁছেছে হরদেব ঘোষালের কানে। তারপরেই সে ছুটে এসেছিল আমার কাছে। তাকে চেপে রাখব। এমন সাধ্য নেই আমার।
তারপর?
হরদেব অবশ্য ভাল কথা বলেছে। আপনার মেয়ে তো ঘেন্নায় এর নাম মুখেও আনে না। স্বীকারই করে না বিয়ে হয়েছিল। সম্পত্তি সে ছুঁয়েও দেখবে না। তাহলে তার নামে বড় অংশ লিখিয়ে লাভ কি? সইসবুদ যখন আমিই করছি তখন পুরোটাই আমার নামে লিখিয়ে নেওয়া ভাল। হরদেব যদ্দিন বেঁচে থাকবে দেখাশোনা করবে, আমি মাসোহারা দেব। লোকটা অবশ্য শেয়াল, তবে শেয়ালের বুদ্ধিকে কাজে লাগালে সিংহের হাত থেকে বাঁচা যায়। তাছাড়া ওর নজর ছিল আমার ওপর অনেক দিনের। পায়নি বলেই শত্ৰুতা করছিল। এরকম লোককে বশ মানাতে পারলে কোন চিন্তা থাকে না। কথা শেষ করে আনা এগিয়ে গেল আলমারির দিকে। সেটি খুলে অমরনাথের দেওয়া উইলটি বের করে বলল, এটা রেখে কোন লাভ নেই।
অমরনাথ দেখলেন আনা ওটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলছে। তিনি, হতভম্ব হয়ে গেলেন। নারীর এ কি রূপ। টুকরোগুলো একটা কাগজে মুড়ে আনা বলল, ব্যস। হয়ে গেল। আর কোন চিহ্ন রইল না।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। হরদেবকে শকুন বলা হয়েছিল!
সত্যি কথা। দেখুন, আমি মেয়েছেলে। পাশের ঘরের লোকটার পা নাড়ার ক্ষমতা নেই তবু তিনি বেঁচে আছেন বলেই মাথার ওপর একটা পুরুষ আছে। পুরুষ ছাড়া মেয়েছেলে মানে আঢাকা খাবার ছাদে রাখা। উনি আপনাকে আমার দায়িত্ব নিতে বলেছিলেন। আপনি বা কাড়েননি। পঁচিশ ভাগ দিয়েই হাত মুছে নিতে চান। কোন পচিশ ভাগ। এই বাড়ির এক সিকি জমি? তা দিয়ে কি করব আমি?
তা কেন? আমি কি আপনাকে ঠকাতাম?
শুধু কথায় চিড়ে ভেজে মুখুজ্জে মশাই?
শুনেছি আপনার আত্মীয়স্বজন আছে দেশে–।
অতীত, অতীত। আমি তো অতীত হইনি। এখনও ভগবান শরীরটা রেখেছেন। শরীরে সাধ আহ্বাদ আছে। যৌবনের শুরুতে ওই পাশের ঘরের উনি যে জ্বালা তৈরী করে দিয়েছিলেন তা যে করে মিটবে কে জানে! আনা হাসল, তা বলে আপনার সঙ্গে আমার কোন শত্ৰুতা নেই। আপনি কুটুম মানুষ, যখন খুশী তখন আসবেন। এতদিন ছাদ ছিল মাথাব ওপর এখন ছাতি বেছে নিলাম। সুবিধে হল এই ছাতির বাঁট আমার হাতেই ধরা থাকবে।
তাহলে সব সম্পত্তি নিজের নামে করে নেওয়া হল?
উপায় কি? আনা হাসল।
অমরনাথ উঠে দাঁড়ালেন। কেমন যেন অসহায় লাগছে নিজেকে। হঠাৎ তিনি প্রশ্নটা করলেন, তা এর জন্যে এত জল ঘোলা হল কেন? আমাকে না ডেকে প্রথম দিকেই তো নিজের নামে করে নেওয়া যেত।
বললাম যে, মেয়েমানুষের মন। আপনার মেয়েকে পুরো ঠেকাতে ইচ্ছে ছিল না। জানলে তিনিও সই করতেন না। এখনও আশালতা করে যাচ্ছেন। কিন্তু যেই বুঝতে পারলাম। আপনার মেয়ে নখ দিয়েও এ বাড়ির বিষয় ছোবে না। তখন আর মনে হল না। ঠকাচ্ছি। পাঁচভূতের পেটে না গিয়ে আমিই ভোগ করি। আনা ঘুরে দাঁড়াল, কি খাবেন বলুন, চা না সরবৎ?
কিছু না। যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালেন অমরনাথ।
আর একটা কথা। আনা মৃদুস্বরে বলল। অমরনাথ থেমে গেলেন।
হরদেব আর আপনার মধ্যে পছন্দ করতে গেলে আমার মন প্রথম জনকে কখনই মেনে নিতে পারে না। তাই অপেক্ষা করছিলাম। তাই রাজী করেছিলাম ভাগ করে নিতে। এখন বুঝে গেছি গাছের পাখির থেকে হাতের পাখি ঢের ভাল।
অমরনাথ হন হন করে বেরিয়ে এলেন। নিজেকে খুব ক্ষুদ্র লাগছিল তাঁর। এবং সেই সঙ্গে কিঞ্চিৎ অসহায়। কোন নারী, সে দাসী অথবা মহারাণীই হোক তাঁকে কামনা করে হতাশ হয়ে এমন কাণ্ড করবে তা কখনও চিন্তায় ছিল না। যা হোক, খুব বড় ফাঁড়া কেটে গেল মনে করতে গিয়ে আর এক ধরনের হতাশ বোধ তাঁকে আচ্ছন্ন করছিল। এত বড় সম্পত্তি একেবারে হাতছাড়া হয়ে গেল?
গেটের কাছে পৌঁছেই শক্ত হলেন অমরনাথ। চুপিসানো মুখে হাসতে হাসতে হরদেব ঘোষাল আসছে। দুটো হাত মাথার ওপরে ঠেকিয়ে হরদেব বলল, নমস্কার অমরনাথবাবু, ধন্য আপনি। অমন আদর্শবতী কন্যার পিতা সবাই হতে পারে না।
মানে? অমরনাথ ফিস ফিস করলেন।
এক কথায় বলে দিল প্রতুলের সম্পত্তি সে ছুঁয়েও দেখবে না।
আপনার সঙ্গে করে কথা হল? গতকাল। মাঝখানে একবার হোস্টেলে যেতে বলেছিল। আমি যাইনি। কি দরকার! আপনিও নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু আনু যখন বলল আমাকে তার প্রয়োজন তখন দেখা করতে গেলাম। সব বললাম।
বললেন?
হ্যাঁ। আমি মিথ্যাচার করতে পারব না। তবে ওই ব্যাঙ্কের টাকার কথা বলিনি। তা সে বলল প্রতুল। যদি লিখেও দেয়। তবুও নেবে না। আমার কাজ হয়ে গেল। কাল রাত্রে দুজনে বসে সব ঠিক করে নিয়েছি। আজ প্রতুল সই করযে, আমি সাক্ষী হব। তারপরেই সমস্ত সম্পত্তি আনুর নামে কোর্টে আইনসম্মত করিয়ে নেব। এটা ঠিক, আনু যা করেছে সব তো তারই পাওনা হরদেব হাসলেন।
আনু?
আনা। প্রতুল তো আদর করে আনু ডাকত। বুনো বেড়াল।
আর তখনই দূরে বাড়ির ভেতর থেকে উচ্চস্বরে কান্না ভেসে এল। হরদেব চমকে উঠল, আনুর গলা! কি হল? প্রতুল টেসে গেল? সর্বনাশ। উইল তো এখনও সই কাবানো হয়নি। পড়ি কি মারি করে হরদেব ছুটল বাড়ির দিকে। অমরনাথ আর যেতে পারলেন না। বুক থেকে না উঠলে এমন কান্না মানুষ কাঁদতে পারে না....
২৩. দুর্দান্ত ব্যবসাদার প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়
খুব দ্রুত থানার পাশ দিয়ে হাঁটছিলেন অমরনাথ।
চোখের সামনে এখনও প্রতুলবাবু। কিংবা বলা যেতে পারে একটি মৃত নগ্ন শরীর, বিছানায় শুয়ে শুয়ে যার সবঙ্গে ক্ষত দাগ দগ করছে, জীয়নকালে যিনি ছিলেন দুর্দান্ত ব্যবসাদার প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়, এখন অসহায় অবস্থায় খাটের ওপর পড়ে আছেন। মাথার পাশে বসে আনা যে কাঁদছিল, তাতে বানানো ব্যাপার কিছু ছিল না। আনার কান্না এত স্বাভাবিক যে অমরনাথও ভাবাবেগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। হরদেব ঘোষাল ঘরে ঢুকে একপলক দৃশ্যটি দেখলেন। তারপরে ছুটে গেলেন খাটের পাশে, কবজি টেনে পালস দেখার চেষ্টা করলেন, চোখের পাতা ধরে টানাটানির পর উদোমশরীর থেকে খসে পড়া চাদরটিকে সস্থানে ফিরিয়ে দিলেন। দিয়ে বললেন, যাই, ডাক্তার ডেকে আনি।
কান্না থামিয়ে আনা ফ্যালফ্যাল করে তাকাল, ডাক্তার?
নিশ্চয়ই। প্ৰাণ আছে কি নেই বোঝার যোগ্যতা একমাত্র ডাক্তারের আছে। থাকলে তিনি চিকিৎসা করবেন, গেলে একটা সাটিফিকেট দেবেন। ততক্ষণ গলা সাধা বন্ধ বাখো। এভাবে ফন্ট করে মরে গেলে তোমার কোন লাভ হবে না। ঘুরে দাঁড়িয়ে হরদেব অমরনাথকে দেখলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখে যেন দুশ্চিন্তা খেলে গেল, অমরনাথবাবু, মনে হচ্ছে খুব দুর্বলভাবে নাড়ি চলছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডান দিকের মোড়ের মাথায় সন্তোষ ডাক্তার থাকেন। তাঁকে ডেকে আনবেন একবার?
অমরনাথ ব্যস্ত হয়ে বললেন, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।
প্ৰায় ঝড়ের মত দৌড়ে গেলেন অমরনাথ। সন্তোষ ডাক্তার সব শুনে বললেন, প্ৰাণ যদি থেকেও থাকে তাহলে কিছু করার নেই। আপনি এগোন, আমি যাচ্ছি।
ব্যানার্জিবাড়িতে ফেরার পথে হঠাৎ মনে হল হরদেব তাঁকে ইচ্ছে করে ওই সময় সরিয়ে দিল না তো! আত্মীয়স্বজনরা আসার আগে কিছু হাতিয়ে নিতে পারে। মৃতদেহ খুব বেশী দেখেননি। অমরনাথ এ জীবনে, কিন্তু প্রতুলবাবুর শরীরের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মনে হয়েছিল তাঁর প্রাণ নেই। বাড়ির সেই বুড়ে চাকব অথবা নিজে ডাক্তারের কাছে না গিয়ে কেন তাঁকে পাঠালেন হরদেব?
সদর দরজা দিয়ে না। ঢুকে বাগানের পথে পা রাখলেন অমরনাথ। বুড়ে চাকরিটা চুপচাপ বসেছিল। একবার চোখ তুলে মুখ নামিয়ে নিল। খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল লোকটাকে। অমরনাথ প্ৰায় নিঃশব্দে পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। প্রতুলবাবুর ঘরের দিকে পৌঁছানো মাত্র হরদেবের গলা কালে এল, তাড়াতাড়ি কর। প্রত্যেক পাতায় ছাপ দাও। যেসব জায়গায পেন্সিলের টিক আছে তার ওপরে। উইলে সই না করলে কি আছে, টিপসই দিয়েছে তো! যে মানবে না। সে কারুক কেস।
অমরনাথ দরজায় দাঁড়ালেন। ভূত দেখার মত চমকে উঠল আনা। এবং হরদেব কিছু বলার আগেই সে দুই হাতে উইলটাকে মুচড়ে ফেলল।
হরদেব খুব দুঃখিত ভাবে বললেন, প্রতুল যা করতে চেয়েছিল তা সুস্থ অবস্থায় করে যেতে পারেনি। বিছানায় পড়ে রইল কত বছর। আমায় বলেছিল। দি টুপ করে সে মরে যায় তাহলে অন্তত এই উইলে ওর টিপছাপ তুলে রাখি। দুর্জনের তো অভাব নেই। ওর শেষ ইচ্ছা পূৰ্ণ করছি এখন। হে হেঁ করে একটু হেসে আরও যোগ করলেন, কিন্তু কার জন্যে করব? স্ত্রীবুদ্ধির নমুনা দেখলেন? আপনাকে দেখে ও এমন ঘাবড়ে গেল যেন চুরি করছে। উইলটার কি অবস্থা করল দেখুন! আরো অমরনাথবাবু যখন পৌঁছে গিয়েছেন তখন সাক্ষী হিসেরে ওঁর সই নিতে হবে না? দাও উইলটা। হরদেব হাত বাড়ালেন।
সত্যি চোরের মত দাঁড়িয়ে ছিল আনা। এবার হরদেব হাত বাড়ানো মাত্র সে সচল হল। কোন কথা না বলে মুচড়ে ফেলা উইলটাকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। হরদেব চিৎকার করলেন, আরে? কি হল? সব ছাপ দেওয়া হয়ে গিয়েছে। আনা? ও আনু।
আর এইসময় ডাক্তারবাবুর গলা পাওয়া গেল সদর দরজায়। তাঁকে দরজা খুলে দিয়ে আর দাঁড়ালেন না অমরনাথ। আর সেই সময় পেছন থেকে আনা তাঁকে ডাকল, শুনুন।
থমকে দাঁড়িয়ে মুখ ফেরালেন অমরনাথ। আনার হাতে তখনও গোল করে পাকানো উইল ধরা, একটা অনুরোধ রাখবেন?
অমরনাথ জবাব দিলেন না। আনা বলল, আমাকে যত খারাপ ভাবেন তাতে আমার
কিছু এসে যায় না। ওঁর শেষ ইচ্ছে ছিল আশালতাকে দেখা। হল না। আপনি ওকে একবার নিয়ে আসবেন?
কি দরকার? অমরনাথ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
বললাম তো ওঁর ইচ্ছা পূৰ্ণ করতে।
যেভাবে হরদেব শেষ ইচ্ছা পূৰ্ণ করছিলেন।
বাড়িতে মড়া পড়ে আছে। এই অবস্থায় তর্ক করবেন?
অমরনাথ আর দাঁড়াননি। হনাহনিয়ে বেরিয়ে এসে করলা নদী পেরিয়ে থানার রাস্তা ধরেছিলেন। লোভ মানুষকে কত নীচে নামাতে পারে তার সবচেয়ে নগ্ন উদাহরণ দেখে উদ্রাস্ত হয়ে পড়ছিলেন বারংবার। কোন দিকে নজর ছিল না। তাঁর। হঠাৎ কানো গেল বাবা শব্দটি। দ্বিতীয়বারে মনে হল গলাটি তাঁর চেনা। মুখ ফিরিয়ে তিন চারটি মেয়েকে দেখলেন। তিনটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে চুপটি করে, একটি এগিয়ে আসছে। এবার দীপা স্পষ্ট হল। অমরনাথ যেন হুঁস ফিরে এলেন।
সামনে দাঁড়িয়ে দীপা জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে তোমার? তিনবার ডাকলাম, শুনতেই পাচ্ছ না।
তুই এখানে? অমরনাথ স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করছিলেন।
বাঃ আমরা কলেজে যাচ্ছি। তুমি কখন এসেছ জলপাইগুড়িতে?
আজ সকালে। অমরনাথ সত্যি কথাই বললেন।
তাহলে আমার কাছে যাওনি কেন? দীপা জিজ্ঞাসা করল। অমরনাথ ঘুরে দাঁড়ানো মেয়েদের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, দীপু, তুমি তোমার বন্ধুদের বলে কলেজে চলে যেতে। তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।
কোথায়? দীপা অবাক হচ্ছিল।
বলছি। আগে ওদের ছেড়ে দাও। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়েছে।
দীপা মেয়েদের কাছে গিয়ে কিছু বলল। তারা অমরনাথকে দেখতে দেখতে পোস্ট অফিসের দিকে হাঁটতে লাগল। ফিরে এসে দীপা জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে। বাবা? অমরনাথ এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে জানতে চাইলেন, এই সময় কলেজে না গিয়ে অন্য কোথায় যাওয়ার জন্যে কি হোস্টেল থেকে অনুমতি নিতে হয়?
না। দীপা মাথা নাড়ল।
সে কি! তাহলে তো তোমরা যেখানে ইচ্ছে যেতে পাব!
আমরা কলেজে পড়ছি বাবা। স্কুলে নয়। খারাপ জায়গায় যাবই বা কেন? দীপা হেসে ফেলেই গম্ভীর হবার চেষ্টা করল, কিন্তু তোমার কি হয়েছে বল তো? কিছু লুকিয়ে যাচ্ছ!
এই সময় একটা খালি রিকশা সামনে দেখে অমরনাথ সেটাকে দাঁড় করালেন, ওঠে। দীপা আদেশ মান্য করল। অমরনাথ পাশে বসে রিকশাওয়ালাকে হাত তুলে ইশারা করলেন রাস্তা দেখিয়ে। এবং তখনই তাঁর মনে হল মেয়ে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। একজন ভদ্রমহিলার পাশেই বসে আছেন এমন অনুভূতি হচ্ছিল।
থানার পাশ দিয়ে রিকশা ঝুলনা পুলের গায়ে এসে থামল। অমরনাথ বুঝলেন তিনি ভুল রাস্তায় রিকশাওয়ালাকে আসতে বলেছেন। করলা নদীর ওপর ঝুলনা পুলে রিকশা উঠবেই না। সেই সুভাষ বোসের স্ট্যাচু অথবা দীনবাজার ঘুরে আসতে হবে। তাতে সময় লগত বেশী। এইটুকু রাস্তা পেরিয়ে ঝুলনা পুলে আসতে রিকশার কোন প্রয়োজন ছিল না। পয়সা দিয়ে মেয়েকে বললেন, চল।
কুলনা পুলে উঠে। দীপা জিজ্ঞাসা করল, আমরা কোথায় যাচ্ছি বাবা?
ব্যানার্জী বাড়িতে।
না।
দীপা, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ একভাবে মাপতে যেও না।
আমি ওই বাড়িতে যাব না।
আমি তোমাকে কখনও যেতে বলিনি। কিন্তু আজ বলছি।
কেন? ওদের সঙ্গে তো আমার কোন সম্পর্ক নেই।
ইচ্ছে না করলেও কোন কোন কাজ করতেই হয়। সম্পর্ক তুমি স্বীকার না করলেও আমাদের মানতে হয়। তোমাকে এখন ব্যানার্জী লিখতে হচ্ছে। আর সম্পর্ক যে-মানুষগুলোকে কেন্দ্র করে ও বাড়িতে তৈরী হয়েছিল তারা কেউ আর আজ বেঁচে নেই। প্রতুলবাবু আজ সকালে পরলোকগমন করেছেন।
সেই ভয়ঙ্কর রাগী মানুষটির মুখ মনে পড়ল দীপার। মুখেব সব কিছু আর তেমন স্পষ্ট নয়। কিন্তু আদলটি মুছছে না। এখনও। মেয়েকে চিন্তিত দেখে অমরনাথ বললেন, আমরা আর কদিন! সবাইকেই যেতে হবে। প্রতুলবাবুও গেলেন। মৃতের প্রতি শ্ৰদ্ধা জানানো যে-কোন জীবিত মানুষের কর্তব্য। চল।
না। শক্ত হয়ে দাঁড়াল দীপা। নিচে করলাব কালো জল স্থির। দুই এক জন লোক যারা ঝুলনা পল দিয়ে যাতাযাত করছে তারা কৌতূহলী হয়ে এদের দিকে তাকিয়ে যাচ্ছিল। অমরনাথ বলে ফেললেন, বেয{দপি করে না দীপা।
দীপা জবাব দিল না। নদীর দিকে এতকাল। এবং তখনই তার দুচোখ ঝাপসা হয়ে গেল। অমরনাথ সেটা দেখতে পেলেন না। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, আমি তোমাকে আদেশ করছি তাই তুমি যাবে।
চোখ মোছার চেষ্টা করল না দীপা। অমরনাথকে সে অনুসরণ করল। বাতাস বইছে। তার ছোঁয়ায় চোখের জল গালে শুকিয়ে যাচ্ছে। সমস্ত শরীর জুড়ে কাঁপুনি, ইচ্ছের বিরুদ্ধে অমরনাথ তাকে দিয়ে যে কাজ কাবাচ্ছেন তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বাসনা ক্রমশ তাকে শক্ত করল। দীপা মনে মনে প্ৰতিজ্ঞা করল, এই শেষ। যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোন কিছুর সঙ্গে সমঝোতা করবে না। অমরনাথ কিংবা অঞ্জলি যদি অন্যায় ভাবে কিছু তার ওপর চাপিয়ে দবার চেষ্টা করেন তাহলে সেটা ঝেড়ে ফেলতে দ্বিধা করবে না। এই শেষ, শেষবার।
এর মধ্যে বেশ কিছু লোকজন এসে গিয়েছে। পাড়াপ্রতিবেশীরা আছেনই, আত্মীয়স্বজনরাত আসতে শুরু করেছেন। মেয়েকে নিয়ে অমরনাথ ঘরের এককোণে দাঁড়িয়েছিলেন। আনা ইতিমধ্যে প্রতুলবাবুকে পাঞ্জাবি পরিয়ে বুক অবধি চাদরে ঢেকে রেখেছে। হরদেব ঘোষাল অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে সব তদারকি করছিল। আনা বসে আছে প্রতুলবাবুর পায়ের কাছে। যাঁরা এসেছেন তাঁরা নিচু গলায় কথা বলছিলেন। জেলার কংগ্রেস-কতারা মালা ফুল নিয়ে পৌঁছে গেলেন। দেখতে দেখতে প্রতুলবাবু এতকালের একাকিতু কাটিয়ে তাঁর কর্মময় জীবনের প্রাপ্য সম্মান অর্জন করতে চললেন। জলপাইগুড়ি শহরের একজন প্রথিতযশা মানুষ চলে গিয়েছেন এবং তাঁকে বিদায় জানাবার ব্যাপারটা যাতে সম্মানের সঙ্গে হয় তার আয়োজন চলছিল। এই সময় হরদেব প্রতুলবাবুর দাদাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলেন। বয়স বেড়েছে। হাতে লাঠি। অমরনাথ দেখলেন ভদ্রলোক খুব একটা বদলাননি। এই মানুষটি যদি হরিদাসবাবুর বাড়িতে তাঁকে ডাকিয়ে নিয়ে গিয়ে দীপার বিয়ের প্রস্তাব না দিতেন তাহলে মেয়েটাকে বিধবা হতে হত না। অমরনাথ অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করলেন।
প্রতুলবাবুর দাদা দরজায় দাঁড়িয়ে প্রথমে মৃতদেহের দিকে তাকালেন, তারপর তাঁর চোখ ঘরের মানুষগুলোর ওপর ঘুরতে লাগল। অমরনাথ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়েছিলেন। প্রতুলবাবুর দাদা কয়েক পা এগিয়ে এসে বললেন, হরদেববাবু, প্রতুল আমার নিজের ভাই নয়। কিন্তু রক্তের সম্পর্ক রয়েছে। সে মারা না গেলে আমি এই বাড়িতে পা দিতাম না। আজ এসেছি। ওই রক্তের সম্পর্কের জন্যে। আসতে বাধ্য হয়েছি।
হরদেব নিচু স্বরে বললেন, অত্যন্ত সত্যি কথা।
খাটের ওপর কে বসে আছেন?
আনা।
আনা! মানে প্রতুলের– ওঁকে কথা শেষ করতে দিলেন না হরদেব, হ্যাঁ।
ওকে নেমে আসতে বলুন। ব্যাপারটা অসম্মানজনক।
হরদেব মিনমিন করে বললেন, উনিই এতদিন সব সেবাযত্ন একা করে এসেছেন।
ভালকথা। কিন্তু সেবিকা সেবিকাই। সে কখনও আত্মীয়ের মর্যাদা পেতে পারে না।
হরদেব ছুটে গেলেন আনার কাছে। কথাগুলো সে-ও শুনেছিল। কিন্তু তার কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। হরদেব আনার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললেন, ঝামেলা না করে নেমে আসাই ভাল। পাঁচজন চেয়ে দেখছে।
আনা তবু নড়ল না। তার মুখ নিচু। অধৈৰ্য হরদেব ডাকলেন, আনা!
আনা উত্তর দিল না। প্রতুলবাবুর দাদা গলা তুললেন, আশ্চর্য! এ তো দেখছি কান কাটা মেয়েছেলে! অমরনাথবাবু, আপনি একটু শুনবেন?
অমরনাথ চমকে উঠলেন। হঠাৎ যে তাঁর নাম উচ্চারণ করবেন। ভদ্রলোক তিনি ভাবতে পারেননি। সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে বললেন, আমাকে কিছু বলছেন?
হ্যাঁ। প্রতুলবাবুর দাদা দরজায় দাঁড়িয়েই কথা বলছিলেন, যতদূর মনে হচ্ছে আপনি এখানে কন্যাকে নিয়ে এসেছেন। তাই তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ। অমরনাথ ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলেন না।
প্রতুলবাবুর দাদা যেন খুব স্বস্তি পেলেন। অমরনাথরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন সেখানে এগিয় এসে বললেন, এসো মা, দূরে দাঁড়িয়ে থেকো না, তুমি এই বাড়ির বউ। প্রতুলের স্ত্রী পুত্র নেই, তুমিই তার পরবারের একমাত্র জীবিত মানুষ। ওর এই সময়ে তুমি তোমার কর্তব্য পালন কর।
অমরনাথ কিছু বলার আগেই দীপা পরিষ্কার গলায় জিজ্ঞাসা করল, কিভাবে?
প্ৰতুলবাবুর দাদা বললেন, অত দূরে দাঁড়িয়ে থেকো না। মৃতের পাশে তার নিকট আত্মীয়রা থাকবে। সেটাই স্বাভাবিক।
দীপা ঠোঁট কামড়াল। ঘরের সমস্ত মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে।
অমরনাথ মেয়ের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, আসলে এ বাড়িতে ওর আসা-যাওয়া নেই তাই সংকোচ–।
প্রতুলবাবুর দাদা কথাটা থামিয়ে দিলেন, সংকোচের কোন কারণ নেই। আসা-যাওয়া বন্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। এখন সেই প্রসঙ্গ তোলার কোন যুক্তি নেই। হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ না করা পর্যন্ত বৈবাহিক সম্পর্ক বাতিল হয় না। আর ওর না হয় আসা-যাওয়া ছিল না। কিন্তু আপনি তো নিয়মিত এসেছেন।
আমি! অমরনাথ। হতভম্ব।
সব খবর কানে এসেছে আমার। এতদিন বলার দরকার মনে করিনি। তাছাড়া এখানে এসে আপনি অন্যায় কিছু করেননি। এসো মা।
দীপা মাথা নাড়ল, না। উনিই ওখানে বসার যোগ্য মানুষ।
মানে? প্রতুলবাবুর দাদা চমকে উঠলেন, এর পরিচয় তুমি জানো?
হ্যাঁ। উনি আমাকে রক্ষা করেছিলেন।
আমি বুঝতে পারছি না।
বোঝার কি খুব দরকার আছে? ওই মহিলা যখন জীবন দিয়ে সেবা করে গেছেন বছরের পর বছর তখন আপনারা কেউ বাধা দেননি। সাহায্য করতেও আসেননি। আজ কেন গায়ে পড়ে নিজের মতামত চাপিয়ে দিচ্ছেন।
প্ৰতুলবাবুর দাদা অবাক হয়ে তাকালেন। তারপর ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। অমরনাথ দেখলেন হরদেব খুব খুশি হয়েছে। শোকসংবাদ পেয়ে যারা এসেছে তারা গুঞ্জন শুরু করল। আনা ওই একই অবস্থায় বসে আছে। তার দিকে তাকিয়ে বিস্ময় বাডছিল অমরনাথের। ওই মহিলা প্রতুলবাবুর মৃত্যুব পারে হরদেবের নির্দেশ যখন মান্য করছিল তখন অন্য চেহারা ছিল। কোনটে সত্যি আর অভিনয় বোঝা অসম্ভব।
এই সময় একটি যুবক এসে অমরনাথের সামনে দাঁড়াল, আপনাদের বাবা ডাকছেন।
চেহারা দেখে অমরনাথ অনুমান করলেন ছেলেটি প্রতুলবাবুর দাদাবাঁ ছেলে। তিনি দীপাকে বললেন, আয় মা।
এই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে দীপা যেন বেঁচে গেল। যে মানুষটি খাটের ওপর শুয়ে আছে তার সঙ্গে কিদয়েব সময় দেখা প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোন মিল নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওদিকে তাকালে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল!
অমরনাথের সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে দীপা দেখল শ্মশানযাত্রীবা প্ৰস্তৃত। ভিড় আরও বাড়ছে। শুধু হাকিমপাড়া নয়, জলপাইগুড়িবা অনেক মানুষ এসেছেন। এখানে। বাগানের মধ্যে একা দাঁড়িয়েছিলেন প্রতুলবাবুর দাদা। সামনে যেতেই তিনি বললেন, অমরনাথবাবু, আমি আমার বেয়াই-এর বাড়িতে গিয়ে আগ বাড়িয়ে আপনাকে বিয়ের সম্বন্ধটা দিয়েছিলাম। এই কারণে আমি পরে অনুতপ্ত হয়েছি। এখন বললে বেঙ্গ বিশ্বাস করবে না। প্রতুলেব অসুস্থতার পরো ব্যাপারটা আমার জানা ছিল না। তারপর অনেক বছর কেটে গেছে। আপনার মেয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে। তার আচরণ নিয়ে যখন নানান কথা আমার কানে এসেছে তখন ভেবেছিলাম মেয়েটা সেই আঘাত ভুলতে পেরেছে। কিন্তু তাই বলে আজ সবার সামনে আপনার মেয়ে আমাকে অপমান করব সাহস পায় কোথেকে? সেদিনের অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছিলাম আজ; এই বাড়িব, প্রতুলের সম্পত্তির অধিকার তাকে দিতে চেয়েছি। সর্বসমক্ষে কিন্তু তার বদলে—! ছি ছি ছি।
অমরনাথ বললেন, আপনি ভুল বুঝছেন। ও আপনাকে ভাল করে চেনেই না! খামোক অপমান করতে যাবে কেন?
অপমান নয়? আপনি এ কি বলছেন? ওই নষ্ট মেয়েটাকে সমর্থন করল, আমাকে বলল গায়ে পড়ে চাপিয়ে দিচ্ছি, এসব শুনতে পাননি?
দীপা শুনছিল এতক্ষণ। এবার অমরনাথকে বলল, বাবা, আমরা কি যাব?
যাবে মানে? প্রতুলবাবুর দাদা আঁতকে উঠলেন, এখন শ্মশানযাত্রা শুরু হয়নি। আর তুমি যেতে চাইছ? না, বাড়ির বউকে শ্মশানে যেতে বলছি না। কিন্তু এখানে এসেছ ঘোমটা না দিয়ে তার ওপর এখন বেরিয়ে গেলে আমাদের সম্মান থাকবে?
দীপা ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট বলল, দেখুন, আমি এখানে নিজের ইচ্ছায় আসিনি। বাবা জোর করেছিলেন বলেই আসতে হল।
তুমি কি নির্বোধ?
মানে?
এসব কথা বলার অর্থ কি জানো?
যা সত্যি তাই আমি বলছি।
অমরনাথবাবু, আপনার মেয়েকে বুঝিয়ে বলুন। এসব কথা উচ্চারণ করার অর্থ এই পরবারের সমস্ত সম্পত্তি থেকে সরে দাঁড়ানো।
দীপা হাসল, এখানেও আপনি ভুল করেছেন।
ভুল?
যে সর্বনাশ একদিন আপনারা আমার করেছিলেন আজ তার প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যে ব্যাকুল হয়েছেন। খুব ভাল। কিন্তু এ বাড়ির একটা টুকরোকেও নিজের করে ভাবাব কোন প্ৰবৃত্তি আমার নেই। বাবা, বল।
দাঁড়াও। ছোট মুখে অনেক বড় কথা বললে।
বড় কথা কিনা জানি না, এটা আমার বিশ্বাসের কথা।
যারা দিনের আলোয় উপদেশ দেয় আর রাতের অন্ধকারে চুরি করে এই ব্যযসে তুমি তাদের দলে পৌঁছে যেতে পেরেছ দেখে অবাক হচ্ছি!
কি বলছেন আপনি?
তুমি কি ভাবছ আমি জানি না যে তোমার বাবা ওই মেয়েছেলেটার সঙ্গে এক হয়ে তোমাকে সম্পত্তির ভাগ দেবার চেষ্টা করছে?
সে কি?
অথচ সেটা তুমি নিজেই এক অধিকার করতে পারতে। আমি ব্যাপারটার কোন অর্থ বুঝতে পাবিনি এতকাল। আজ যখন ওই মেয়েছেলেটাকে তুমি সমর্থন করলে তখন অর্থটা হৃদয়ঙ্গম হল।
আপনি আমার বাবার নামে মিথো বদনাম দিচ্ছেন।
অমরনাথ কিন্তু কিন্তু করে বললেন, প্রতুলবাবু চেয়েছিলেন বলে–।
মিথ্যে বদনাম! কি অমরনাথবাবু ব্যাপারটা কি মিথ্যে?
তুমি আমাকে এসব কথা কখনও বলনি বাবা? দীপার গলার স্বর কেপৌ উঠল। তার প্রশ্ন শুনে অমরনাথ মাথা নিচু করলেন।
প্রতুলবাবুর দাদা বললেন, যাচ্চলে।! ঠিক আছে, বিষয়সম্পত্তির ব্যাপারটা না হয় তোমার বাবা তোমাকে বলেননি। কিন্তু চা-বাগান থেকে জলপাইগুড়ি শহরে এসে হোস্টেলে বাস করে এই যে পড়াশুনা করছ—।
এই সময় শ্মশানযাত্রীরা হরিধ্বনি দিতে দিতে প্রতুলবাবুর দেহ খাটে চাপিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। একটি মাত্র কঠের কান্না শোনা যাচ্ছিল। সেদিকে তাকিয়ে প্রতুলবাবুর দাদা বললেন, থাক। আর কিছু বলার নেই।
দীপা বাধা দিল, দাঁড়ান। আমার পড়াশুনার ব্যাপারে কি বলছিলেন?
যেতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন ভদ্রলোক, এতক্ষণ তুমি অনেক বড় কথা বললে মা। তোমার অপমানিত হবার কারণ যথেষ্ট আছে। তবে দুরকম আচরণ করা ঠিক নয়। তুমি এ বাড়ির সম্পত্তি, এ বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক যদি অস্বীকার কর তাহলে প্রতুলের দেওয়া টাকায় পড়াশুনা করা ঘোরতর অন্যায়।
প্রতুলবাবুর দাদা আর দাঁড়ালেন না। শব মিছিলের সঙ্গী হতে ছেলেকে নিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগলেন। তখন চারধার হরিধ্বনিতে উচ্চকিত। মিছিল একটু একটু করে বেরিয়ে গেল বড় রাস্তায়। বলহরি-হরিবোল শব্দদুটো আর দীপার কাছে পৌঁছাচ্ছিল না। সে পাথরের মত দাঁড়িয়েছিল। প্রতুলবাবুর দাদা কথাগুলো বলার পর থেকেই তার সমস্ত অনুভূতি লোপ পেয়ে গিয়েছিল।
অমরনাথ অত্যন্ত অসহায় বোধ করছিলেন। মেয়ের কাছে লুকিয়ে রাখা খবরগুলো প্রতুলবাবুর দাদা যে এভাবে বলে যাবেন তা তাঁর ধারণার বাইরে ছিল। ঠিক কুরেছিলেন, মেয়ে গ্র্যাজুয়েট হবার পর এক সময় নিজেই খুলে বলবেন। এমন হবে জানলে তিনি নিশ্চয়ই জোর করে দীপাকে নিয়ে আসতেন না। এখন মাথা তুলতেও তাঁর সংকোচ হচ্ছিল। কিন্তু প্রতুলবাবু, হরদেব ঘোষাল আর তিনি ছাড়া একমাত্র আনা আর অঞ্জলি ব্যাপারটা জানে। আনা জানে কিনা সে-ব্যাপারেও তিনি নিঃসন্দেহ নন। ব্যাপারটা গোপন রাখতে তিনি প্রতুলবাবুকে সেইসময় অনুরোধ করেছিলেন। তাহলে এই ভদ্রলোক খবরটা পেলেন কি করে? তিনি যে মাঝে মধ্যে এ বাড়িতে আসা-যাওয়া করেছেন তাও ভদ্রলোকের অজানা নয়। অমরনাথের মনে হল আর কিছু করার নেই। তিনি মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে ভরসা পাচ্ছিলেন না।
এই সময় সেই বুড়ে কর্মচারিটি এগিয়ে এসে দীপার সামনে দাঁড়াল। খুব বিনীত গলায় বলল, আপনাকে ডাকছে
দীপা তাকাল। কিন্তু কোন প্রশ্ন করুল না। লোকটি আবার বলল, আনাদি আপনাকে একবার আসতে বললে।
এবার দীপা সচল হল। অমরনাথ দেখলেন তাঁকে কোন কথা না বলে দীপা ধীরে ধীরে লোকটির সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। কিছু প্ৰতিবেশী মহিলা তখনও দাঁড়িয়েছিলেন বাড়ির সামনে। তাঁরা সকৌতূহলে তাকিয়ে আছেন দীপার দিকে। অমরনাথ এগোতে পারলেন না। দীপা ধীরে ধীরে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলে তিনি পায়চারি করতে লাগলেন বাগানে।
শূন্য বাড়ি। প্রতুলবাবুর শরীর বের করে নিয়ে যাওয়ায়র সঙ্গে সঙ্গে যাব ফোঁড় হয়েছিল তারাত বেরিয়ে এসেছিল। বৃদ্ধ একটি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দীপাকে ইশারা করল, ভিতরে। দীপা ঘরে ঢুকল। লোকটি চলে গেল।
আনা বসেছিল তক্তাপষেবা ওপর। তার হাতের মুঠোয় আঁচল এবং সেটি মুখে চাপা। পিঠ ফুলে ফুলে উঠছে। দীপা কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখল। তারপর কথা বলল, কিছু বলবেন?
আনা মুখ তুলল। তার কান্না সোচ্চার হওয়ামাত্র সে সামলাবার চেষ্টা করল। তারপর জড়ানো গলায় জিজ্ঞাসা করল, আমার কি হবে?
দীপার বোধগম্য হল না, সে প্রশ্ন করল, কি ব্যাপারে?
তোমরা কি আমাকে তাড়িয়ে দেবে? কান্না গলার দখল ছাড়ছিল না।
তো তাডাবার কেউ নই।
তুমিই সব। বল, তুমি কি আমাকে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলবে?
আবার বলছি আমি কেউ নই। কিন্তু আপনার চলে যাওয়ার কথা হচ্ছে কেন?
দি সবার সামনে আমাকে জানিয়ে দেওয়া হল আমি ওরা দাসী।
আপনি কি নিজেকে তার চেয়ে বেশী ভাবেন?
হ্যাঁ। শুধু দাসী হলে এতগুলো বছর আমি মানুষটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইতাম না। খুব খারাপ, বন্দ লোক ছিল, তবু—। কান্নাটা বন্ধ করতে আনা মুখে আঁচল চাপা দিল।
আমি যাই?
না। আনা হঠাৎই উঠে দাঁড়িয়ে করুণ স্বরে বলল, তুমি যেও না, তুমি না থাকলে ওরা আমাকে এ বাড়ি থেকে দূর করে দেবে।
কেউ আপনাকে সেটা করতে পারবে না। আচ্ছা, ওঁর স্ত্রী কোথায়?
সে কি! তুমি জানো না?
না।
তিনি নেই। পাগলাগারদেই মারা গিয়েছেন।
পগলা গারদ।
হ্যাঁ। শোন আশালতা–।
আপনি আমাকে ওই নামে ডাকরেন না।
ও। তুমি একটু বসো। তোমাকে আমি সব কথা বলব।
আমার কোন কথা শোনার একটুও ইচ্ছা নেই।
না। শুনতে হবে। একদিন আমি তোমার উপকার করেছিলাম, সেই অধিকারে তোমাকে বলছি, একটু বসো। কথা বলতে বলতে আনা দরজার কাছে পৌঁছে সেটাকে ভেজিয়ে দিল। আনাকে হঠাৎ উন্মাদিনীর মত দেখাচ্ছিল। তার আঁচল মাটিতে লুটোচ্ছে, চুল আলুথালু। দীপা হতাশভঙ্গীতে খাটে এসে বসল। আনার মুখ দেখে মনে হল এতে পে একটু সন্তুষ্ট হয়েছে।
হঠাৎই দীপার সামনে মেঝেতে বসে পড়ল আনা। দীপা প্ৰতিবাদ করতে গিয়েও থেমে গেল। আনা বলল, উনি তো মানুষ ভালছিলেন না। সারা জীবন টাকা আর মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করেছেন। ঘরের বউ-এর ক্ষমতা ছিল না। তাঁকে সুখী করে। কোন কোন পুরুষমানুষের চাহিদা বাক্ষসের মত, একমাত্র রাক্ষসী না হলে সেটা মেটাতে পারে না। সেই কাজটা করেছিলাম। আমি। তাঁকে ঘরে ফিরিয়েছিলাম। গিন্নিই আমাকে লেলিয়ে দিয়েছিল। ছেলের অসুখের পর তার মাথা সব সময় ঠিক কাজ করত না। যাক এসব কথা। গিন্নি চলে গেছেন পাগলাগারদে থাকার সময়। খবরটা তোমার বাবা জানতেন। কর্তাকে জানানো হয়নি। কতা যখন প্ৰথম বিছানায় পড়লেন তখন থেকেই তাঁর বিবেক দংশন আরম্ভ হল। তোমার প্রতি যে অন্যায় করেছেন তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইলেন।
আনা নিঃশ্বাস নিতে একটু চুপ করতেই দীপা জিজ্ঞাসা করল, উনি কি আমার পড়াশুনার জন্যে টাকা দিয়েছেন?
হ্যাঁ। জোর করেই। তোমার বাবা নিতে চাইছিলেন না। ওই হরদেব শকুনটা জোর করে নেওয়ালেন। নিশ্চয়ই সে ভাগ নিতে ছাড়েনি। তবে, শুনেছি, টাকাটা ব্যাঙ্কে আছে, তা থেকে সুদ যায় তোমার কাছে।
কত টাকা?
ঠিক জানি না। কতা আমাকেও বিশ্বাস করে পুরোটা বলেননি।
তারপর?
উনি চাইতেন তুমি এ বাড়িতে এসে থাকে। ওঁর শরীর আরও খারাপ হতে লািগল। এই সম্পত্তি তোমাকে দিতে চেয়েছিলেন। আমি বলতাম, আমার কি হবে? তিনি বলতেন, তোকেও কিছু দেব। শেষ দিকে যখন বুঝে গেলেন তুমি আসবে না। তখন আর সম্পত্তির ব্যাপারে কিছু বলতেন না। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলে একটা উইল তৈরী করলাম। আমি খুব চেষ্টা করেছিলাম ওঁকে দিয়ে সই করাতে। কিন্তু তখন ওঁর হাত উঠত না। এই সময় হরদেব শেয়াল আমাকে কুমতলব দিল। আমি একা মেয়েমানুষ। শরীর এখনও শুকিয়ে যায়নি। পুরুষমানুষের কুনজর চিতায় না ওঠা পর্যন্ত মরে না। ভাবলাম, এতদিন বাঘের হাতে ছিলাম। এখন না হয় শেয়ালের হাতে থাকি। প্রশ্ৰয পেয়ে হরদেব মাথায় উঠল। সে তোমাকে ঠকাতে বলল। নতুন উইল হল। সব সম্পত্তি বিষয়-আশয় আমার নামে। তদারকি করবে। হরদেব। দিনরাত বলতে সই কবাতে। যিনি করবেন তাঁর তখন আঙ্গুল সরে না। বলল, টিপসই করাতে। করব করার করে যখন ইস হল তখন তিনি নেই। ওই মরা মানুষটার আঙ্গুলে কালি মাখিয়ে ছাপ লাগাতে চেয়েছিল শেয়ালটা। আর তখন ভগবান আমাকে সম্বিত ফিরিয়ে দিলেন। সব ছিডে ফেলেছি। কিন্তু কে জানত ওঁর আত্মীয় এসে পাঁচজনের সামনে আমাকে খাট থেকে টেনে নামাতে চাইবে! তুমি বলছি সম্পত্তি চাই না, আমাকে কুকুর বেড়ালের মত তাডাবে আর পাঁচভূতে সব দখল করবে। করুক। কিন্তু তুমি বল, আমার অপরাধ কোথায়?
দীপা কোন জবাব দিল না। সে অবাক হয়ে আনাব মুখেব দিকে তাকিয়েছিল। যা শুনছে তা কি সত্যি? হরদেব ঘোষাল তাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে যে কথাগুলো বলেছিলেন তা মনে পড়ল। চা-বাগানে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন ব্যাপারটা। কিন্তু অমরনাথ এখনও সেই প্রসঙ্গ তোলেননি। আনা যা বলছে তাতে কি মিথ্যে আছে? দুটো যোগ করলে–তো—! এমন কি প্রতুলবাবুর দাদাও একই কথা বলে গেলেন। কেঁপে উঠল দীপা। সে কি করবে বুঝতে পারছিল না। আমন্ত্ৰনাথ তাকে মিথ্যে কথা বলেছেন? জলপাইগুড়ির বিখ্যাত চা-বাগানোবা মালিক পায়পরবার থেকে তাকে তার মেধাবী জন্যে বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে না?
অনা দীপার হাত ধরল, শোন, তুমি আমাকে বক্ষা কর।
কি ভাবে? দুর্বল গলায় বলল দীপা।
ওদের বল আমি এ বাড়ি ছেড়ে যেতে পারব না।
আপনার কেউ নেই?
আছে। একটা ছেলে। আমাদের দেশে। হাওডায়। সেখানে আমার যাওয়ার মুখ নেই। কিতার টাকাব্য সে বড় হচ্ছে।
ওর বাবা নেই?
না। সে কতবাবুর ছেলে। এখন হরদেব শেয়াল ছাড়া একথা কেউ জানে না। আমি বলতেও চাই না। এই পরিচয় দেবার তো উপায় নেই। আইন মানবে না। আনা আরও ঘনিষ্ঠ হল, তুমি হোস্টেলে থেকে না। এই বাড়িতে চলে এস। তোমার মধ্যে একধরনের তেজ আছে। কেউ কাছে ঘেষতে সাহস পারে না।
আপনি আমাকে বাঁচাতে এ বাড়ি থেকে একদিন চলে যেতে সাহায্য করেছিলেন। আজ কেন—। দীপা মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল।
সত্যি কথা বলব? তোমাকে বাঁচাবার চেয়েও সেদিন আমার মনে হয়েছিল তুমি চলে গেলে কতাবাবুকে আমি নিজের মত করে পাব। কেঁদে উঠল আনা।
সেই মহিলার দিকে কয়েক সেকেন্ড অপলক তাকিয়ে ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে এল দীপা। দরজার বাইরে সেই বৃদ্ধ চাকরীটি অসহায় চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। দীপা কোন দিকে লক্ষ্য না করে হাঁটছিল। মৃত্যুশোক নয়, একটি নির্মম সত্যের শোষণ তার জীবনকে নীরক্ত করে দিয়েছে কয়েক মিনিটে।
অমরনাথ মেয়েকে দেখে চমকে উঠলেন। দ্রুত পা চালিয়ে কাছে এসে তিনি উদ্বেগে প্রশ্ন করলেন, কি হয়েছে দীপু?
দীপা অমরনাথের দিকে তাকাল। সেই দৃষ্টির সামনে তিনি কেঁপে উঠলেন। দীপা নিচু গলায় বলল, তুমি কেন এত লোভী হলে! ছিঃ!।
খুব দ্রুত থানার পাশ দিয়ে হাঁটছিলেন অমরনাথ।
চোখের সামনে এখনও প্রতুলবাবু। কিংবা বলা যেতে পারে একটি মৃত নগ্ন শরীর, বিছানায় শুয়ে শুয়ে যার সবঙ্গে ক্ষত দাগ দগ করছে, জীয়নকালে যিনি ছিলেন দুর্দান্ত ব্যবসাদার প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়, এখন অসহায় অবস্থায় খাটের ওপর পড়ে আছেন। মাথার পাশে বসে আনা যে কাঁদছিল, তাতে বানানো ব্যাপার কিছু ছিল না। আনার কান্না এত স্বাভাবিক যে অমরনাথও ভাবাবেগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। হরদেব ঘোষাল ঘরে ঢুকে একপলক দৃশ্যটি দেখলেন। তারপরে ছুটে গেলেন খাটের পাশে, কবজি টেনে পালস দেখার চেষ্টা করলেন, চোখের পাতা ধরে টানাটানির পর উদোমশরীর থেকে খসে পড়া চাদরটিকে সস্থানে ফিরিয়ে দিলেন। দিয়ে বললেন, যাই, ডাক্তার ডেকে আনি।
কান্না থামিয়ে আনা ফ্যালফ্যাল করে তাকাল, ডাক্তার?
নিশ্চয়ই। প্ৰাণ আছে কি নেই বোঝার যোগ্যতা একমাত্র ডাক্তারের আছে। থাকলে তিনি চিকিৎসা করবেন, গেলে একটা সাটিফিকেট দেবেন। ততক্ষণ গলা সাধা বন্ধ বাখো। এভাবে ফন্ট করে মরে গেলে তোমার কোন লাভ হবে না। ঘুরে দাঁড়িয়ে হরদেব অমরনাথকে দেখলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখে যেন দুশ্চিন্তা খেলে গেল, অমরনাথবাবু, মনে হচ্ছে খুব দুর্বলভাবে নাড়ি চলছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডান দিকের মোড়ের মাথায় সন্তোষ ডাক্তার থাকেন। তাঁকে ডেকে আনবেন একবার?
অমরনাথ ব্যস্ত হয়ে বললেন, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।
প্ৰায় ঝড়ের মত দৌড়ে গেলেন অমরনাথ। সন্তোষ ডাক্তার সব শুনে বললেন, প্ৰাণ যদি থেকেও থাকে তাহলে কিছু করার নেই। আপনি এগোন, আমি যাচ্ছি।
ব্যানার্জিবাড়িতে ফেরার পথে হঠাৎ মনে হল হরদেব তাঁকে ইচ্ছে করে ওই সময় সরিয়ে দিল না তো! আত্মীয়স্বজনরা আসার আগে কিছু হাতিয়ে নিতে পারে। মৃতদেহ খুব বেশী দেখেননি। অমরনাথ এ জীবনে, কিন্তু প্রতুলবাবুর শরীরের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মনে হয়েছিল তাঁর প্রাণ নেই। বাড়ির সেই বুড়ে চাকব অথবা নিজে ডাক্তারের কাছে না গিয়ে কেন তাঁকে পাঠালেন হরদেব?
সদর দরজা দিয়ে না। ঢুকে বাগানের পথে পা রাখলেন অমরনাথ। বুড়ে চাকরিটা চুপচাপ বসেছিল। একবার চোখ তুলে মুখ নামিয়ে নিল। খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল লোকটাকে। অমরনাথ প্ৰায় নিঃশব্দে পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। প্রতুলবাবুর ঘরের দিকে পৌঁছানো মাত্র হরদেবের গলা কালে এল, তাড়াতাড়ি কর। প্রত্যেক পাতায় ছাপ দাও। যেসব জায়গায পেন্সিলের টিক আছে তার ওপরে। উইলে সই না করলে কি আছে, টিপসই দিয়েছে তো! যে মানবে না। সে কারুক কেস।
অমরনাথ দরজায় দাঁড়ালেন। ভূত দেখার মত চমকে উঠল আনা। এবং হরদেব কিছু বলার আগেই সে দুই হাতে উইলটাকে মুচড়ে ফেলল।
হরদেব খুব দুঃখিত ভাবে বললেন, প্রতুল যা করতে চেয়েছিল তা সুস্থ অবস্থায় করে যেতে পারেনি। বিছানায় পড়ে রইল কত বছর। আমায় বলেছিল। দি টুপ করে সে মরে যায় তাহলে অন্তত এই উইলে ওর টিপছাপ তুলে রাখি। দুর্জনের তো অভাব নেই। ওর শেষ ইচ্ছা পূৰ্ণ করছি এখন। হে হেঁ করে একটু হেসে আরও যোগ করলেন, কিন্তু কার জন্যে করব? স্ত্রীবুদ্ধির নমুনা দেখলেন? আপনাকে দেখে ও এমন ঘাবড়ে গেল যেন চুরি করছে। উইলটার কি অবস্থা করল দেখুন! আরো অমরনাথবাবু যখন পৌঁছে গিয়েছেন তখন সাক্ষী হিসেরে ওঁর সই নিতে হবে না? দাও উইলটা। হরদেব হাত বাড়ালেন।
সত্যি চোরের মত দাঁড়িয়ে ছিল আনা। এবার হরদেব হাত বাড়ানো মাত্র সে সচল হল। কোন কথা না বলে মুচড়ে ফেলা উইলটাকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। হরদেব চিৎকার করলেন, আরে? কি হল? সব ছাপ দেওয়া হয়ে গিয়েছে। আনা? ও আনু।
আর এইসময় ডাক্তারবাবুর গলা পাওয়া গেল সদর দরজায়। তাঁকে দরজা খুলে দিয়ে আর দাঁড়ালেন না অমরনাথ। আর সেই সময় পেছন থেকে আনা তাঁকে ডাকল, শুনুন।
থমকে দাঁড়িয়ে মুখ ফেরালেন অমরনাথ। আনার হাতে তখনও গোল করে পাকানো উইল ধরা, একটা অনুরোধ রাখবেন?
অমরনাথ জবাব দিলেন না। আনা বলল, আমাকে যত খারাপ ভাবেন তাতে আমার
কিছু এসে যায় না। ওঁর শেষ ইচ্ছে ছিল আশালতাকে দেখা। হল না। আপনি ওকে একবার নিয়ে আসবেন?
কি দরকার? অমরনাথ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
বললাম তো ওঁর ইচ্ছা পূৰ্ণ করতে।
যেভাবে হরদেব শেষ ইচ্ছা পূৰ্ণ করছিলেন।
বাড়িতে মড়া পড়ে আছে। এই অবস্থায় তর্ক করবেন?
অমরনাথ আর দাঁড়াননি। হনাহনিয়ে বেরিয়ে এসে করলা নদী পেরিয়ে থানার রাস্তা ধরেছিলেন। লোভ মানুষকে কত নীচে নামাতে পারে তার সবচেয়ে নগ্ন উদাহরণ দেখে উদ্রাস্ত হয়ে পড়ছিলেন বারংবার। কোন দিকে নজর ছিল না। তাঁর। হঠাৎ কানো গেল বাবা শব্দটি। দ্বিতীয়বারে মনে হল গলাটি তাঁর চেনা। মুখ ফিরিয়ে তিন চারটি মেয়েকে দেখলেন। তিনটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে চুপটি করে, একটি এগিয়ে আসছে। এবার দীপা স্পষ্ট হল। অমরনাথ যেন হুঁস ফিরে এলেন।
সামনে দাঁড়িয়ে দীপা জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে তোমার? তিনবার ডাকলাম, শুনতেই পাচ্ছ না।
তুই এখানে? অমরনাথ স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করছিলেন।
বাঃ আমরা কলেজে যাচ্ছি। তুমি কখন এসেছ জলপাইগুড়িতে?
আজ সকালে। অমরনাথ সত্যি কথাই বললেন।
তাহলে আমার কাছে যাওনি কেন? দীপা জিজ্ঞাসা করল। অমরনাথ ঘুরে দাঁড়ানো মেয়েদের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, দীপু, তুমি তোমার বন্ধুদের বলে কলেজে চলে যেতে। তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।
কোথায়? দীপা অবাক হচ্ছিল।
বলছি। আগে ওদের ছেড়ে দাও। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়েছে।
দীপা মেয়েদের কাছে গিয়ে কিছু বলল। তারা অমরনাথকে দেখতে দেখতে পোস্ট অফিসের দিকে হাঁটতে লাগল। ফিরে এসে দীপা জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে। বাবা? অমরনাথ এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে জানতে চাইলেন, এই সময় কলেজে না গিয়ে অন্য কোথায় যাওয়ার জন্যে কি হোস্টেল থেকে অনুমতি নিতে হয়?
না। দীপা মাথা নাড়ল।
সে কি! তাহলে তো তোমরা যেখানে ইচ্ছে যেতে পাব!
আমরা কলেজে পড়ছি বাবা। স্কুলে নয়। খারাপ জায়গায় যাবই বা কেন? দীপা হেসে ফেলেই গম্ভীর হবার চেষ্টা করল, কিন্তু তোমার কি হয়েছে বল তো? কিছু লুকিয়ে যাচ্ছ!
এই সময় একটা খালি রিকশা সামনে দেখে অমরনাথ সেটাকে দাঁড় করালেন, ওঠে। দীপা আদেশ মান্য করল। অমরনাথ পাশে বসে রিকশাওয়ালাকে হাত তুলে ইশারা করলেন রাস্তা দেখিয়ে। এবং তখনই তাঁর মনে হল মেয়ে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। একজন ভদ্রমহিলার পাশেই বসে আছেন এমন অনুভূতি হচ্ছিল।
থানার পাশ দিয়ে রিকশা ঝুলনা পুলের গায়ে এসে থামল। অমরনাথ বুঝলেন তিনি ভুল রাস্তায় রিকশাওয়ালাকে আসতে বলেছেন। করলা নদীর ওপর ঝুলনা পুলে রিকশা উঠবেই না। সেই সুভাষ বোসের স্ট্যাচু অথবা দীনবাজার ঘুরে আসতে হবে। তাতে সময় লগত বেশী। এইটুকু রাস্তা পেরিয়ে ঝুলনা পুলে আসতে রিকশার কোন প্রয়োজন ছিল না। পয়সা দিয়ে মেয়েকে বললেন, চল।
কুলনা পুলে উঠে। দীপা জিজ্ঞাসা করল, আমরা কোথায় যাচ্ছি বাবা?
ব্যানার্জী বাড়িতে।
না।
দীপা, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ একভাবে মাপতে যেও না।
আমি ওই বাড়িতে যাব না।
আমি তোমাকে কখনও যেতে বলিনি। কিন্তু আজ বলছি।
কেন? ওদের সঙ্গে তো আমার কোন সম্পর্ক নেই।
ইচ্ছে না করলেও কোন কোন কাজ করতেই হয়। সম্পর্ক তুমি স্বীকার না করলেও আমাদের মানতে হয়। তোমাকে এখন ব্যানার্জী লিখতে হচ্ছে। আর সম্পর্ক যে-মানুষগুলোকে কেন্দ্র করে ও বাড়িতে তৈরী হয়েছিল তারা কেউ আর আজ বেঁচে নেই। প্রতুলবাবু আজ সকালে পরলোকগমন করেছেন।
সেই ভয়ঙ্কর রাগী মানুষটির মুখ মনে পড়ল দীপার। মুখেব সব কিছু আর তেমন স্পষ্ট নয়। কিন্তু আদলটি মুছছে না। এখনও। মেয়েকে চিন্তিত দেখে অমরনাথ বললেন, আমরা আর কদিন! সবাইকেই যেতে হবে। প্রতুলবাবুও গেলেন। মৃতের প্রতি শ্ৰদ্ধা জানানো যে-কোন জীবিত মানুষের কর্তব্য। চল।
না। শক্ত হয়ে দাঁড়াল দীপা। নিচে করলাব কালো জল স্থির। দুই এক জন লোক যারা ঝুলনা পল দিয়ে যাতাযাত করছে তারা কৌতূহলী হয়ে এদের দিকে তাকিয়ে যাচ্ছিল। অমরনাথ বলে ফেললেন, বেয{দপি করে না দীপা।
দীপা জবাব দিল না। নদীর দিকে এতকাল। এবং তখনই তার দুচোখ ঝাপসা হয়ে গেল। অমরনাথ সেটা দেখতে পেলেন না। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, আমি তোমাকে আদেশ করছি তাই তুমি যাবে।
চোখ মোছার চেষ্টা করল না দীপা। অমরনাথকে সে অনুসরণ করল। বাতাস বইছে। তার ছোঁয়ায় চোখের জল গালে শুকিয়ে যাচ্ছে। সমস্ত শরীর জুড়ে কাঁপুনি, ইচ্ছের বিরুদ্ধে অমরনাথ তাকে দিয়ে যে কাজ কাবাচ্ছেন তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বাসনা ক্রমশ তাকে শক্ত করল। দীপা মনে মনে প্ৰতিজ্ঞা করল, এই শেষ। যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোন কিছুর সঙ্গে সমঝোতা করবে না। অমরনাথ কিংবা অঞ্জলি যদি অন্যায় ভাবে কিছু তার ওপর চাপিয়ে দবার চেষ্টা করেন তাহলে সেটা ঝেড়ে ফেলতে দ্বিধা করবে না। এই শেষ, শেষবার।
এর মধ্যে বেশ কিছু লোকজন এসে গিয়েছে। পাড়াপ্রতিবেশীরা আছেনই, আত্মীয়স্বজনরাত আসতে শুরু করেছেন। মেয়েকে নিয়ে অমরনাথ ঘরের এককোণে দাঁড়িয়েছিলেন। আনা ইতিমধ্যে প্রতুলবাবুকে পাঞ্জাবি পরিয়ে বুক অবধি চাদরে ঢেকে রেখেছে। হরদেব ঘোষাল অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে সব তদারকি করছিল। আনা বসে আছে প্রতুলবাবুর পায়ের কাছে। যাঁরা এসেছেন তাঁরা নিচু গলায় কথা বলছিলেন। জেলার কংগ্রেস-কতারা মালা ফুল নিয়ে পৌঁছে গেলেন। দেখতে দেখতে প্রতুলবাবু এতকালের একাকিতু কাটিয়ে তাঁর কর্মময় জীবনের প্রাপ্য সম্মান অর্জন করতে চললেন। জলপাইগুড়ি শহরের একজন প্রথিতযশা মানুষ চলে গিয়েছেন এবং তাঁকে বিদায় জানাবার ব্যাপারটা যাতে সম্মানের সঙ্গে হয় তার আয়োজন চলছিল। এই সময় হরদেব প্রতুলবাবুর দাদাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলেন। বয়স বেড়েছে। হাতে লাঠি। অমরনাথ দেখলেন ভদ্রলোক খুব একটা বদলাননি। এই মানুষটি যদি হরিদাসবাবুর বাড়িতে তাঁকে ডাকিয়ে নিয়ে গিয়ে দীপার বিয়ের প্রস্তাব না দিতেন তাহলে মেয়েটাকে বিধবা হতে হত না। অমরনাথ অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করলেন।
প্রতুলবাবুর দাদা দরজায় দাঁড়িয়ে প্রথমে মৃতদেহের দিকে তাকালেন, তারপর তাঁর চোখ ঘরের মানুষগুলোর ওপর ঘুরতে লাগল। অমরনাথ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়েছিলেন। প্রতুলবাবুর দাদা কয়েক পা এগিয়ে এসে বললেন, হরদেববাবু, প্রতুল আমার নিজের ভাই নয়। কিন্তু রক্তের সম্পর্ক রয়েছে। সে মারা না গেলে আমি এই বাড়িতে পা দিতাম না। আজ এসেছি। ওই রক্তের সম্পর্কের জন্যে। আসতে বাধ্য হয়েছি।
হরদেব নিচু স্বরে বললেন, অত্যন্ত সত্যি কথা।
খাটের ওপর কে বসে আছেন?
আনা।
আনা! মানে প্রতুলের– ওঁকে কথা শেষ করতে দিলেন না হরদেব, হ্যাঁ।
ওকে নেমে আসতে বলুন। ব্যাপারটা অসম্মানজনক।
হরদেব মিনমিন করে বললেন, উনিই এতদিন সব সেবাযত্ন একা করে এসেছেন।
ভালকথা। কিন্তু সেবিকা সেবিকাই। সে কখনও আত্মীয়ের মর্যাদা পেতে পারে না।
হরদেব ছুটে গেলেন আনার কাছে। কথাগুলো সে-ও শুনেছিল। কিন্তু তার কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। হরদেব আনার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললেন, ঝামেলা না করে নেমে আসাই ভাল। পাঁচজন চেয়ে দেখছে।
আনা তবু নড়ল না। তার মুখ নিচু। অধৈৰ্য হরদেব ডাকলেন, আনা!
আনা উত্তর দিল না। প্রতুলবাবুর দাদা গলা তুললেন, আশ্চর্য! এ তো দেখছি কান কাটা মেয়েছেলে! অমরনাথবাবু, আপনি একটু শুনবেন?
অমরনাথ চমকে উঠলেন। হঠাৎ যে তাঁর নাম উচ্চারণ করবেন। ভদ্রলোক তিনি ভাবতে পারেননি। সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে বললেন, আমাকে কিছু বলছেন?
হ্যাঁ। প্রতুলবাবুর দাদা দরজায় দাঁড়িয়েই কথা বলছিলেন, যতদূর মনে হচ্ছে আপনি এখানে কন্যাকে নিয়ে এসেছেন। তাই তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ। অমরনাথ ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলেন না।
প্রতুলবাবুর দাদা যেন খুব স্বস্তি পেলেন। অমরনাথরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন সেখানে এগিয় এসে বললেন, এসো মা, দূরে দাঁড়িয়ে থেকো না, তুমি এই বাড়ির বউ। প্রতুলের স্ত্রী পুত্র নেই, তুমিই তার পরবারের একমাত্র জীবিত মানুষ। ওর এই সময়ে তুমি তোমার কর্তব্য পালন কর।
অমরনাথ কিছু বলার আগেই দীপা পরিষ্কার গলায় জিজ্ঞাসা করল, কিভাবে?
প্ৰতুলবাবুর দাদা বললেন, অত দূরে দাঁড়িয়ে থেকো না। মৃতের পাশে তার নিকট আত্মীয়রা থাকবে। সেটাই স্বাভাবিক।
দীপা ঠোঁট কামড়াল। ঘরের সমস্ত মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে।
অমরনাথ মেয়ের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, আসলে এ বাড়িতে ওর আসা-যাওয়া নেই তাই সংকোচ–।
প্রতুলবাবুর দাদা কথাটা থামিয়ে দিলেন, সংকোচের কোন কারণ নেই। আসা-যাওয়া বন্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। এখন সেই প্রসঙ্গ তোলার কোন যুক্তি নেই। হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ না করা পর্যন্ত বৈবাহিক সম্পর্ক বাতিল হয় না। আর ওর না হয় আসা-যাওয়া ছিল না। কিন্তু আপনি তো নিয়মিত এসেছেন।
আমি! অমরনাথ। হতভম্ব।
সব খবর কানে এসেছে আমার। এতদিন বলার দরকার মনে করিনি। তাছাড়া এখানে এসে আপনি অন্যায় কিছু করেননি। এসো মা।
দীপা মাথা নাড়ল, না। উনিই ওখানে বসার যোগ্য মানুষ।
মানে? প্রতুলবাবুর দাদা চমকে উঠলেন, এর পরিচয় তুমি জানো?
হ্যাঁ। উনি আমাকে রক্ষা করেছিলেন।
আমি বুঝতে পারছি না।
বোঝার কি খুব দরকার আছে? ওই মহিলা যখন জীবন দিয়ে সেবা করে গেছেন বছরের পর বছর তখন আপনারা কেউ বাধা দেননি। সাহায্য করতেও আসেননি। আজ কেন গায়ে পড়ে নিজের মতামত চাপিয়ে দিচ্ছেন।
প্ৰতুলবাবুর দাদা অবাক হয়ে তাকালেন। তারপর ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। অমরনাথ দেখলেন হরদেব খুব খুশি হয়েছে। শোকসংবাদ পেয়ে যারা এসেছে তারা গুঞ্জন শুরু করল। আনা ওই একই অবস্থায় বসে আছে। তার দিকে তাকিয়ে বিস্ময় বাডছিল অমরনাথের। ওই মহিলা প্রতুলবাবুর মৃত্যুব পারে হরদেবের নির্দেশ যখন মান্য করছিল তখন অন্য চেহারা ছিল। কোনটে সত্যি আর অভিনয় বোঝা অসম্ভব।
এই সময় একটি যুবক এসে অমরনাথের সামনে দাঁড়াল, আপনাদের বাবা ডাকছেন।
চেহারা দেখে অমরনাথ অনুমান করলেন ছেলেটি প্রতুলবাবুর দাদাবাঁ ছেলে। তিনি দীপাকে বললেন, আয় মা।
এই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে দীপা যেন বেঁচে গেল। যে মানুষটি খাটের ওপর শুয়ে আছে তার সঙ্গে কিদয়েব সময় দেখা প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোন মিল নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওদিকে তাকালে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল!
অমরনাথের সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে দীপা দেখল শ্মশানযাত্রীবা প্ৰস্তৃত। ভিড় আরও বাড়ছে। শুধু হাকিমপাড়া নয়, জলপাইগুড়িবা অনেক মানুষ এসেছেন। এখানে। বাগানের মধ্যে একা দাঁড়িয়েছিলেন প্রতুলবাবুর দাদা। সামনে যেতেই তিনি বললেন, অমরনাথবাবু, আমি আমার বেয়াই-এর বাড়িতে গিয়ে আগ বাড়িয়ে আপনাকে বিয়ের সম্বন্ধটা দিয়েছিলাম। এই কারণে আমি পরে অনুতপ্ত হয়েছি। এখন বললে বেঙ্গ বিশ্বাস করবে না। প্রতুলেব অসুস্থতার পরো ব্যাপারটা আমার জানা ছিল না। তারপর অনেক বছর কেটে গেছে। আপনার মেয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে। তার আচরণ নিয়ে যখন নানান কথা আমার কানে এসেছে তখন ভেবেছিলাম মেয়েটা সেই আঘাত ভুলতে পেরেছে। কিন্তু তাই বলে আজ সবার সামনে আপনার মেয়ে আমাকে অপমান করব সাহস পায় কোথেকে? সেদিনের অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছিলাম আজ; এই বাড়িব, প্রতুলের সম্পত্তির অধিকার তাকে দিতে চেয়েছি। সর্বসমক্ষে কিন্তু তার বদলে—! ছি ছি ছি।
অমরনাথ বললেন, আপনি ভুল বুঝছেন। ও আপনাকে ভাল করে চেনেই না! খামোক অপমান করতে যাবে কেন?
অপমান নয়? আপনি এ কি বলছেন? ওই নষ্ট মেয়েটাকে সমর্থন করল, আমাকে বলল গায়ে পড়ে চাপিয়ে দিচ্ছি, এসব শুনতে পাননি?
দীপা শুনছিল এতক্ষণ। এবার অমরনাথকে বলল, বাবা, আমরা কি যাব?
যাবে মানে? প্রতুলবাবুর দাদা আঁতকে উঠলেন, এখন শ্মশানযাত্রা শুরু হয়নি। আর তুমি যেতে চাইছ? না, বাড়ির বউকে শ্মশানে যেতে বলছি না। কিন্তু এখানে এসেছ ঘোমটা না দিয়ে তার ওপর এখন বেরিয়ে গেলে আমাদের সম্মান থাকবে?
দীপা ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট বলল, দেখুন, আমি এখানে নিজের ইচ্ছায় আসিনি। বাবা জোর করেছিলেন বলেই আসতে হল।
তুমি কি নির্বোধ?
মানে?
এসব কথা বলার অর্থ কি জানো?
যা সত্যি তাই আমি বলছি।
অমরনাথবাবু, আপনার মেয়েকে বুঝিয়ে বলুন। এসব কথা উচ্চারণ করার অর্থ এই পরবারের সমস্ত সম্পত্তি থেকে সরে দাঁড়ানো।
দীপা হাসল, এখানেও আপনি ভুল করেছেন।
ভুল?
যে সর্বনাশ একদিন আপনারা আমার করেছিলেন আজ তার প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যে ব্যাকুল হয়েছেন। খুব ভাল। কিন্তু এ বাড়ির একটা টুকরোকেও নিজের করে ভাবাব কোন প্ৰবৃত্তি আমার নেই। বাবা, বল।
দাঁড়াও। ছোট মুখে অনেক বড় কথা বললে।
বড় কথা কিনা জানি না, এটা আমার বিশ্বাসের কথা।
যারা দিনের আলোয় উপদেশ দেয় আর রাতের অন্ধকারে চুরি করে এই ব্যযসে তুমি তাদের দলে পৌঁছে যেতে পেরেছ দেখে অবাক হচ্ছি!
কি বলছেন আপনি?
তুমি কি ভাবছ আমি জানি না যে তোমার বাবা ওই মেয়েছেলেটার সঙ্গে এক হয়ে তোমাকে সম্পত্তির ভাগ দেবার চেষ্টা করছে?
সে কি?
অথচ সেটা তুমি নিজেই এক অধিকার করতে পারতে। আমি ব্যাপারটার কোন অর্থ বুঝতে পাবিনি এতকাল। আজ যখন ওই মেয়েছেলেটাকে তুমি সমর্থন করলে তখন অর্থটা হৃদয়ঙ্গম হল।
আপনি আমার বাবার নামে মিথো বদনাম দিচ্ছেন।
অমরনাথ কিন্তু কিন্তু করে বললেন, প্রতুলবাবু চেয়েছিলেন বলে–।
মিথ্যে বদনাম! কি অমরনাথবাবু ব্যাপারটা কি মিথ্যে?
তুমি আমাকে এসব কথা কখনও বলনি বাবা? দীপার গলার স্বর কেপৌ উঠল। তার প্রশ্ন শুনে অমরনাথ মাথা নিচু করলেন।
প্রতুলবাবুর দাদা বললেন, যাচ্চলে।! ঠিক আছে, বিষয়সম্পত্তির ব্যাপারটা না হয় তোমার বাবা তোমাকে বলেননি। কিন্তু চা-বাগান থেকে জলপাইগুড়ি শহরে এসে হোস্টেলে বাস করে এই যে পড়াশুনা করছ—।
এই সময় শ্মশানযাত্রীরা হরিধ্বনি দিতে দিতে প্রতুলবাবুর দেহ খাটে চাপিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। একটি মাত্র কঠের কান্না শোনা যাচ্ছিল। সেদিকে তাকিয়ে প্রতুলবাবুর দাদা বললেন, থাক। আর কিছু বলার নেই।
দীপা বাধা দিল, দাঁড়ান। আমার পড়াশুনার ব্যাপারে কি বলছিলেন?
যেতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন ভদ্রলোক, এতক্ষণ তুমি অনেক বড় কথা বললে মা। তোমার অপমানিত হবার কারণ যথেষ্ট আছে। তবে দুরকম আচরণ করা ঠিক নয়। তুমি এ বাড়ির সম্পত্তি, এ বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক যদি অস্বীকার কর তাহলে প্রতুলের দেওয়া টাকায় পড়াশুনা করা ঘোরতর অন্যায়।
প্রতুলবাবুর দাদা আর দাঁড়ালেন না। শব মিছিলের সঙ্গী হতে ছেলেকে নিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগলেন। তখন চারধার হরিধ্বনিতে উচ্চকিত। মিছিল একটু একটু করে বেরিয়ে গেল বড় রাস্তায়। বলহরি-হরিবোল শব্দদুটো আর দীপার কাছে পৌঁছাচ্ছিল না। সে পাথরের মত দাঁড়িয়েছিল। প্রতুলবাবুর দাদা কথাগুলো বলার পর থেকেই তার সমস্ত অনুভূতি লোপ পেয়ে গিয়েছিল।
অমরনাথ অত্যন্ত অসহায় বোধ করছিলেন। মেয়ের কাছে লুকিয়ে রাখা খবরগুলো প্রতুলবাবুর দাদা যে এভাবে বলে যাবেন তা তাঁর ধারণার বাইরে ছিল। ঠিক কুরেছিলেন, মেয়ে গ্র্যাজুয়েট হবার পর এক সময় নিজেই খুলে বলবেন। এমন হবে জানলে তিনি নিশ্চয়ই জোর করে দীপাকে নিয়ে আসতেন না। এখন মাথা তুলতেও তাঁর সংকোচ হচ্ছিল। কিন্তু প্রতুলবাবু, হরদেব ঘোষাল আর তিনি ছাড়া একমাত্র আনা আর অঞ্জলি ব্যাপারটা জানে। আনা জানে কিনা সে-ব্যাপারেও তিনি নিঃসন্দেহ নন। ব্যাপারটা গোপন রাখতে তিনি প্রতুলবাবুকে সেইসময় অনুরোধ করেছিলেন। তাহলে এই ভদ্রলোক খবরটা পেলেন কি করে? তিনি যে মাঝে মধ্যে এ বাড়িতে আসা-যাওয়া করেছেন তাও ভদ্রলোকের অজানা নয়। অমরনাথের মনে হল আর কিছু করার নেই। তিনি মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে ভরসা পাচ্ছিলেন না।
এই সময় সেই বুড়ে কর্মচারিটি এগিয়ে এসে দীপার সামনে দাঁড়াল। খুব বিনীত গলায় বলল, আপনাকে ডাকছে
দীপা তাকাল। কিন্তু কোন প্রশ্ন করুল না। লোকটি আবার বলল, আনাদি আপনাকে একবার আসতে বললে।
এবার দীপা সচল হল। অমরনাথ দেখলেন তাঁকে কোন কথা না বলে দীপা ধীরে ধীরে লোকটির সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। কিছু প্ৰতিবেশী মহিলা তখনও দাঁড়িয়েছিলেন বাড়ির সামনে। তাঁরা সকৌতূহলে তাকিয়ে আছেন দীপার দিকে। অমরনাথ এগোতে পারলেন না। দীপা ধীরে ধীরে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলে তিনি পায়চারি করতে লাগলেন বাগানে।
শূন্য বাড়ি। প্রতুলবাবুর শরীর বের করে নিয়ে যাওয়ায়র সঙ্গে সঙ্গে যাব ফোঁড় হয়েছিল তারাত বেরিয়ে এসেছিল। বৃদ্ধ একটি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দীপাকে ইশারা করল, ভিতরে। দীপা ঘরে ঢুকল। লোকটি চলে গেল।
আনা বসেছিল তক্তাপষেবা ওপর। তার হাতের মুঠোয় আঁচল এবং সেটি মুখে চাপা। পিঠ ফুলে ফুলে উঠছে। দীপা কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখল। তারপর কথা বলল, কিছু বলবেন?
আনা মুখ তুলল। তার কান্না সোচ্চার হওয়ামাত্র সে সামলাবার চেষ্টা করল। তারপর জড়ানো গলায় জিজ্ঞাসা করল, আমার কি হবে?
দীপার বোধগম্য হল না, সে প্রশ্ন করল, কি ব্যাপারে?
তোমরা কি আমাকে তাড়িয়ে দেবে? কান্না গলার দখল ছাড়ছিল না।
তো তাডাবার কেউ নই।
তুমিই সব। বল, তুমি কি আমাকে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলবে?
আবার বলছি আমি কেউ নই। কিন্তু আপনার চলে যাওয়ার কথা হচ্ছে কেন?
দি সবার সামনে আমাকে জানিয়ে দেওয়া হল আমি ওরা দাসী।
আপনি কি নিজেকে তার চেয়ে বেশী ভাবেন?
হ্যাঁ। শুধু দাসী হলে এতগুলো বছর আমি মানুষটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইতাম না। খুব খারাপ, বন্দ লোক ছিল, তবু—। কান্নাটা বন্ধ করতে আনা মুখে আঁচল চাপা দিল।
আমি যাই?
না। আনা হঠাৎই উঠে দাঁড়িয়ে করুণ স্বরে বলল, তুমি যেও না, তুমি না থাকলে ওরা আমাকে এ বাড়ি থেকে দূর করে দেবে।
কেউ আপনাকে সেটা করতে পারবে না। আচ্ছা, ওঁর স্ত্রী কোথায়?
সে কি! তুমি জানো না?
না।
তিনি নেই। পাগলাগারদেই মারা গিয়েছেন।
পগলা গারদ।
হ্যাঁ। শোন আশালতা–।
আপনি আমাকে ওই নামে ডাকরেন না।
ও। তুমি একটু বসো। তোমাকে আমি সব কথা বলব।
আমার কোন কথা শোনার একটুও ইচ্ছা নেই।
না। শুনতে হবে। একদিন আমি তোমার উপকার করেছিলাম, সেই অধিকারে তোমাকে বলছি, একটু বসো। কথা বলতে বলতে আনা দরজার কাছে পৌঁছে সেটাকে ভেজিয়ে দিল। আনাকে হঠাৎ উন্মাদিনীর মত দেখাচ্ছিল। তার আঁচল মাটিতে লুটোচ্ছে, চুল আলুথালু। দীপা হতাশভঙ্গীতে খাটে এসে বসল। আনার মুখ দেখে মনে হল এতে পে একটু সন্তুষ্ট হয়েছে।
হঠাৎই দীপার সামনে মেঝেতে বসে পড়ল আনা। দীপা প্ৰতিবাদ করতে গিয়েও থেমে গেল। আনা বলল, উনি তো মানুষ ভালছিলেন না। সারা জীবন টাকা আর মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করেছেন। ঘরের বউ-এর ক্ষমতা ছিল না। তাঁকে সুখী করে। কোন কোন পুরুষমানুষের চাহিদা বাক্ষসের মত, একমাত্র রাক্ষসী না হলে সেটা মেটাতে পারে না। সেই কাজটা করেছিলাম। আমি। তাঁকে ঘরে ফিরিয়েছিলাম। গিন্নিই আমাকে লেলিয়ে দিয়েছিল। ছেলের অসুখের পর তার মাথা সব সময় ঠিক কাজ করত না। যাক এসব কথা। গিন্নি চলে গেছেন পাগলাগারদে থাকার সময়। খবরটা তোমার বাবা জানতেন। কর্তাকে জানানো হয়নি। কতা যখন প্ৰথম বিছানায় পড়লেন তখন থেকেই তাঁর বিবেক দংশন আরম্ভ হল। তোমার প্রতি যে অন্যায় করেছেন তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইলেন।
আনা নিঃশ্বাস নিতে একটু চুপ করতেই দীপা জিজ্ঞাসা করল, উনি কি আমার পড়াশুনার জন্যে টাকা দিয়েছেন?
হ্যাঁ। জোর করেই। তোমার বাবা নিতে চাইছিলেন না। ওই হরদেব শকুনটা জোর করে নেওয়ালেন। নিশ্চয়ই সে ভাগ নিতে ছাড়েনি। তবে, শুনেছি, টাকাটা ব্যাঙ্কে আছে, তা থেকে সুদ যায় তোমার কাছে।
কত টাকা?
ঠিক জানি না। কতা আমাকেও বিশ্বাস করে পুরোটা বলেননি।
তারপর?
উনি চাইতেন তুমি এ বাড়িতে এসে থাকে। ওঁর শরীর আরও খারাপ হতে লািগল। এই সম্পত্তি তোমাকে দিতে চেয়েছিলেন। আমি বলতাম, আমার কি হবে? তিনি বলতেন, তোকেও কিছু দেব। শেষ দিকে যখন বুঝে গেলেন তুমি আসবে না। তখন আর সম্পত্তির ব্যাপারে কিছু বলতেন না। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলে একটা উইল তৈরী করলাম। আমি খুব চেষ্টা করেছিলাম ওঁকে দিয়ে সই করাতে। কিন্তু তখন ওঁর হাত উঠত না। এই সময় হরদেব শেয়াল আমাকে কুমতলব দিল। আমি একা মেয়েমানুষ। শরীর এখনও শুকিয়ে যায়নি। পুরুষমানুষের কুনজর চিতায় না ওঠা পর্যন্ত মরে না। ভাবলাম, এতদিন বাঘের হাতে ছিলাম। এখন না হয় শেয়ালের হাতে থাকি। প্রশ্ৰয পেয়ে হরদেব মাথায় উঠল। সে তোমাকে ঠকাতে বলল। নতুন উইল হল। সব সম্পত্তি বিষয়-আশয় আমার নামে। তদারকি করবে। হরদেব। দিনরাত বলতে সই কবাতে। যিনি করবেন তাঁর তখন আঙ্গুল সরে না। বলল, টিপসই করাতে। করব করার করে যখন ইস হল তখন তিনি নেই। ওই মরা মানুষটার আঙ্গুলে কালি মাখিয়ে ছাপ লাগাতে চেয়েছিল শেয়ালটা। আর তখন ভগবান আমাকে সম্বিত ফিরিয়ে দিলেন। সব ছিডে ফেলেছি। কিন্তু কে জানত ওঁর আত্মীয় এসে পাঁচজনের সামনে আমাকে খাট থেকে টেনে নামাতে চাইবে! তুমি বলছি সম্পত্তি চাই না, আমাকে কুকুর বেড়ালের মত তাডাবে আর পাঁচভূতে সব দখল করবে। করুক। কিন্তু তুমি বল, আমার অপরাধ কোথায়?
দীপা কোন জবাব দিল না। সে অবাক হয়ে আনাব মুখেব দিকে তাকিয়েছিল। যা শুনছে তা কি সত্যি? হরদেব ঘোষাল তাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে যে কথাগুলো বলেছিলেন তা মনে পড়ল। চা-বাগানে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন ব্যাপারটা। কিন্তু অমরনাথ এখনও সেই প্রসঙ্গ তোলেননি। আনা যা বলছে তাতে কি মিথ্যে আছে? দুটো যোগ করলে–তো—! এমন কি প্রতুলবাবুর দাদাও একই কথা বলে গেলেন। কেঁপে উঠল দীপা। সে কি করবে বুঝতে পারছিল না। আমন্ত্ৰনাথ তাকে মিথ্যে কথা বলেছেন? জলপাইগুড়ির বিখ্যাত চা-বাগানোবা মালিক পায়পরবার থেকে তাকে তার মেধাবী জন্যে বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে না?
অনা দীপার হাত ধরল, শোন, তুমি আমাকে বক্ষা কর।
কি ভাবে? দুর্বল গলায় বলল দীপা।
ওদের বল আমি এ বাড়ি ছেড়ে যেতে পারব না।
আপনার কেউ নেই?
আছে। একটা ছেলে। আমাদের দেশে। হাওডায়। সেখানে আমার যাওয়ার মুখ নেই। কিতার টাকাব্য সে বড় হচ্ছে।
ওর বাবা নেই?
না। সে কতবাবুর ছেলে। এখন হরদেব শেয়াল ছাড়া একথা কেউ জানে না। আমি বলতেও চাই না। এই পরিচয় দেবার তো উপায় নেই। আইন মানবে না। আনা আরও ঘনিষ্ঠ হল, তুমি হোস্টেলে থেকে না। এই বাড়িতে চলে এস। তোমার মধ্যে একধরনের তেজ আছে। কেউ কাছে ঘেষতে সাহস পারে না।
আপনি আমাকে বাঁচাতে এ বাড়ি থেকে একদিন চলে যেতে সাহায্য করেছিলেন। আজ কেন—। দীপা মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল।
সত্যি কথা বলব? তোমাকে বাঁচাবার চেয়েও সেদিন আমার মনে হয়েছিল তুমি চলে গেলে কতাবাবুকে আমি নিজের মত করে পাব। কেঁদে উঠল আনা।
সেই মহিলার দিকে কয়েক সেকেন্ড অপলক তাকিয়ে ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে এল দীপা। দরজার বাইরে সেই বৃদ্ধ চাকরীটি অসহায় চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। দীপা কোন দিকে লক্ষ্য না করে হাঁটছিল। মৃত্যুশোক নয়, একটি নির্মম সত্যের শোষণ তার জীবনকে নীরক্ত করে দিয়েছে কয়েক মিনিটে।
অমরনাথ মেয়েকে দেখে চমকে উঠলেন। দ্রুত পা চালিয়ে কাছে এসে তিনি উদ্বেগে প্রশ্ন করলেন, কি হয়েছে দীপু?
দীপা অমরনাথের দিকে তাকাল। সেই দৃষ্টির সামনে তিনি কেঁপে উঠলেন। দীপা নিচু গলায় বলল, তুমি কেন এত লোভী হলে! ছিঃ!।
1 comments:
Tulis commentsHSC পরিক্ষার্থী ২০২৪ রাত - দিন😇
Reply